ভাষাশহীদদের স্মৃতিচিহ্ন
বই আছে কেউ পড়ে না, জাদুঘরে লোক যায় না
সালামের বাড়ি ফেনী, রফিকের মানিকগঞ্জ, জব্বারের বাড়ি ময়মনসিংহে। স্মৃতি ধরে রাখতে তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়।
ভাষার জন্য, মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা। তাঁদের সেই আত্মত্যাগ আজও শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করে জাতি। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। সেই ভাষাশহীদদের আমরা কতটা মনে রেখেছি! তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারি উদ্যোগই–বা কী! তার খোঁজ করতে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সম্প্রতি গিয়েছিলেন ভাষাশহীদদের বাড়ির ঠিকানায়।
ভাষাশহীদের মধ্যে সালামের বাড়ি ফেনী, রফিকের মানিকগঞ্জ, জব্বারের বাড়ি ময়মনসিংহে। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে ২০০৮ সালে সালাম, রফিক ও জব্বারের নিজ নিজ গ্রামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। সম্প্রতি জাদুঘর তিনটি ঘুরে এগুলোর ‘রুগ্ণ দশা’ চোখে পড়ল। বাইরে থেকে ঝকঝকে, তকতকে দেখালেও গ্রন্থাগার ও জাদুঘরগুলো বিশেষ কোনো কাজ আসছে না। প্রচার–প্রচারণার অভাবে লোকে এগুলো সম্পর্কে জানে না। গ্রন্থাগারে বই থাকলেও পড়তে আসে না কেউ। জাদুঘরে শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন বলতে কিছু নেই। লোকজন এসে হতাশ হয়ে ফিরে যায়।
করণীয় কী জানতে চাইলে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই জাদুঘরগুলো নষ্ট হোক, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। গণমানুষের চেতনা জাগ্রত রাখতে হলে আমাদের এই স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। এই সংরক্ষণ শুধু সময়ের জন্য নয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেন ধারণ করতে পারে, সে জন্য সরকারকে চেষ্টা করতে হবে।
সালামের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই
শহীদ আবদুস সালামের বাড়ি ফেনী শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষ্মণপুর গ্রামে। সেই গ্রামের নাম ‘ভাষাশহীদ সালাম নগর’।
গতকাল রোববার সালাম নগর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ঝকঝকে–তকতকে একটি একতলা ভবন। ভেতরে ঢুকতেই বড় একটি হলরুম। কক্ষের দেয়ালে ভাষাশহীদের ছবি টানানো। আছে ১১টি আলমারি, হাজার পাঁচেক বই, আর ছয়টি টেবিল; সঙ্গে কিছু চেয়ার। কিন্তু পাঠক নেই। গ্রন্থাগারটি নিয়মিত খোলা হয় না। জাদুঘরে শহীদ সালামের একটি ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। লোকজনও খুব একটা আসে না। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার) আছেন। ভবনের সামনে মাঠের একপাশে ভাষাশহীদ আবদুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অপর পাশে শহীদ মিনার।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম বললেন, গ্রন্থাগারে চার-পাঁচ হাজার বই থাকলেও সেখানে উপেক্ষিত শহীদ সালাম। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে জাদুঘরটি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু সারা বছর এখানে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড থাকে না। অনেক সময় দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এই গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর দেখতে এসে হতাশ হন। তবে শহীদ দিবস এলে মানুষের আনাগোনা বাড়ে, অনেকেই দেখতে আসেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এখানে।
কথা হয় ভাষাশহীদ সালামের ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আবদুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নামকরণ ভাষাশহীদ সালামের নামে করা হয়।
ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবদুল করিম বলেন, তাঁদের চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে আবদুস সালাম ছিলেন সবার বড়। তখন গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। মাতুভূঞা করিম উল্যা হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। মেট্রিক (এসএসসি) পাসের আগেই পরিবারের বড় ছেলে ঢাকায় শিল্প দপ্তরে চাকরি নেন। দেশপ্রেমিক সালাম একজন কর্মচারী হয়েও ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহীদ হন।
শহীদ সালামের স্মৃতিচিহ্ন খোয়া গেছে বলে জানালেন আবদুল করিম। বললেন, শহীদ সালামের রক্তমাখা জামাকাপড় তাঁর বাবা অনেক বছর সংরক্ষণ করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে প্রভাতফেরিসহ বিভিন্ন মিছিল–সমাবেশে তাঁর বাবা ছেলের রক্তমাখা সেই জামাকাপড় নিয়ে যেতেন। সেসব জামাকাপড় ঘর থেকে পরে চুরি হয়ে যায়।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর সম্পর্কে দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা আক্তারের ভাষ্য, শহীদ সালামের কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকায় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা যায়নি। তবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে গ্রন্থাগারে বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন ও নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
রফিকনগরে যাওয়ার রাস্তা ভাঙাচোরা
ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের স্মরণে ও স্মৃতি রক্ষায় গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রফিকনগরে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়। সংরক্ষণের অভাবে স্মৃতি জাদুঘরে নেই ভাষাশহীদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে যাতায়াতের রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভরা। এসব কারণে পাঠক ও দর্শনার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
গত শুক্রবার দেখা যায়, গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে বাইরে ধোয়ামোছার কাজ চলছে। ভেতরে ১২টি আলমারিতে সাজানো আছে বই। কয়েকজন পাঠক বসে বই পড়ছেন। কয়েকজন দর্শনার্থী জাদুঘরটি দেখতে এসেছেন। স্মৃতি জাদুঘরে শহীদের স্মৃতিচিহ্ন না পেয়ে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান ফরহাদ হোসেন খান বলেন, পাঠকেরা নতুন বই পড়তে চান। দেখতে চান রফিকের স্মৃতিচিহ্ন। তবে এখানে রফিকের শুধু দুটি ছবি ও একটি ম্যুরাল ছাড়া কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। থাকলে পাঠক ও দর্শনার্থী বাড়তে পারে।
শহীদ রফিকের ভাই খোরশেদ আলমের কথায়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁদের বাবা কলকাতা থেকে এসে পুরান ঢাকায় প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। দেবেন্দ্র কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে ওঠার পর রফিক লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। তখন বাবা তাঁকে ঢাকা নিয়ে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি করে দেন। পাশাপাশি নিজের প্রেস ব্যবসায় যুক্ত করেন তাঁকে। সুই ও সুতায় নকশা আঁকায় রফিক ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি নিজের ব্যবহৃত রুমাল ও টেবিলক্লথেও সুই ও সুতায় নকশা এঁকেছেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রফিকের বিয়ের কথা চলছিল। পারিবারিকভাবে গ্রামের এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বের হলে রফিক ওই মিছিলে অংশ নিতে যান। পথে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
কথা হয় শহীদের ভাতিজা আবদুর রউফের সঙ্গে। তিনি বলেন, হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটির প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। তবে ইটভাটায় মাটি ও ইট আনা-নেওয়ার ট্রাক চলাচল করায় রাস্তাটিতে কার্পেটিং উঠে খানাখন্দে ভরে গেছে।
রফিকের স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে একটি পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, টেবিল, চেয়ার ও রফিকের নিজ হাতে নকশা করা একটি টেবিলক্লথ আছে বলে জানান শহীদের ভাই খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, জাদুঘরে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে রফিকের ব্যবহৃত এসব জিনিস জেলা শহরে তাঁর বাসায় রয়েছে। ভাষাশহীদের পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ক্রেস্ট ও সম্মাননাগুলো জাদুঘরে দেবেন, যদি তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটির দেখভালের দায়িত্ব জেলা পরিষদের। এ প্রসঙ্গে পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহীউদ্দীন বলেন, ভাষাশহীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র জাদুঘরে দেওয়ার জন্য পরিবারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। শহীদের এসব স্মৃতি জাদুঘরে যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হবে।
স্মৃতিচিহ্ন নেই জব্বারেরও
অপ্রাপ্তি, আক্ষেপ আছে ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের নিজ গ্রামে অবস্থিত গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি নিয়েও। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাঁচুয়া গ্রামে স্মৃতি জাদুঘরটি অবস্থিত। যাতায়াতের নেই তেমন সুবিধা। এখানেও জাদুঘরে শহীদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। বিশাল পাঠাগারে অসংখ্য বই তাকে তাকে সাজানো থাকলেও নেই পাঠক।
স্থানীয়দের ভাষ্য, ভাষা আন্দোলনের এ শহীদের গ্রামে এ ধরনের একটি স্মৃতি জাদুঘর তাঁদের জন্য অনেক গৌরবের। সারা বছর এ গ্রন্থাগার ও জাদুঘর খোলা থাকে। বছরজুড়ে দর্শনার্থী তেমন না থাকলেও ভাষার মাসে মানুষজন এখানে আসে। এ ছাড়া প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জাদুঘর প্রাঙ্গণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জানতে চাইলে গফরগাঁওয়ের ইউএনও আবিদুর রহমান গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন যোগদান করেই জাদুঘরটিতে পাঠক কম থাকার বিষয়টি জেনেছি। প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উন্নয়নে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে কাজ করব।’
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রন্থাগারের ভেতরে আলমারিতে ইতিহাস, বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, কবিতা, উপন্যাস ও গল্পের বই ছাড়াও রয়েছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী নিয়ে কয়েক হাজার বই।
স্মৃতি জাদুঘরে রক্ষিত তথ্য বলছে, আবদুল জব্বার ধোপাঘাট কৃষ্টবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁর পড়াশোনা থেমে যায়। ১০ বছর বয়সে তিনি বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যুক্ত হন। ১৫ বছর বয়সে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ১০–১২ বছর পর আবার নিজ গ্রাম ফেরেন তিনি। পরে আনসার বাহিনীতে যোগদান করেন তিনি।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের গ্রন্থাগারিক কায়সারুজ্জামান বলেন, গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ভবনের আয়তন প্রায় ১ হাজার ৪৬০ বর্গফুট। প্রায় ৫ হাজার বই আছে। প্রতিদিন হাতে গোনা কিছু পাঠক এখানে আসেন। ভাষাশহীদ জব্বারের স্মৃতিচিহ্ন এখানে নেই। বিষয়টি তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলে জানান।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন আবু তাহের, ফেনী; আব্দুল মোমিন, মানিকগঞ্জ ও কামরান পারভেজ, ময়মনসিংহ]