বইঠার এলোপাতাড়ি আঘাতে বাঘকে ঘাবড়ে দিয়েছিলেন আবু
জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে খালের পাড়ে নেমেছিলেন তিনজন। হঠাৎ বনের ভেতর থেকে একটি বাঘ বেরিয়ে আসে। আবু হায়াত ঢালী মনকে বোঝান, বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। হাল ছাড়লে চলবে না। হাতে থাকা নৌকার বইঠা দিয়ে সাধ্যমতো এলোপাতাড়ি বাড়ি দিতে শুরু করেন। সঙ্গে থাকা নূর ইসলাম গাজী ও বাবলু সানাও বইঠা দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকেন। বাঘ তাতে ঘাবড়ে যায়। বাঘের থাবা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে আবু হায়াত ঢালী বাড়ি ফেরেন।
বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের এই তিন জেলে। প্রাণে বেঁচে ফিরে এলেও সুন্দরবনের কৈখালী ফরেস্ট স্টেশনের দারগাং খালপাড়ের আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি আবু হায়াত ঢালীর। চোখের কোনা, মাথা, মুখসহ কয়েকটি জায়গায় ক্ষত হলেও মনের অদেখা ক্ষতটাই বেশি ভোগাচ্ছে তাঁকে। রাতে ঘুমের মধ্যেও বাঘে থাবা দিচ্ছে—এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।
৪৫ বছর বয়সী আবু হায়াত ঢালী বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানো বা থাবা থেকে বেঁচে আসা মানুষের গল্প শুনেছেন। এবার নিজের জীবনেই সে ঘটনা ঘটে গেছে, তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ৮ ফেব্রুয়ারি আবু হায়াতকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন ১০ ফেব্রুয়ারি।
গত বুধবার মুঠোফোনে কথা হয় আবু হায়াত ও তাঁর স্ত্রী রাশিদা বেগমের সঙ্গে। এই দম্পতি এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। আরেক মেয়ের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। হাসপাতালে ক্ষত জায়গাগুলো ড্রেসিং করতে হয়েছে। এখনো ক্ষতের জায়গাগুলো ভোগাচ্ছে তাঁকে। ক্ষতের গভীরতা বোঝাতে রাশিদা বলেন, হাসপাতালে ক্ষতস্থানের গর্তগুলোয় তুলা গুঁজে রাখা হতো।
আবু হায়াত জানান, বন বিভাগের অনুমতি নিয়েই সেদিন তিনি মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার আগে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য তাঁরা তিনজন খালের পাড়ে নেমেছিলেন। মনে বাঘের ভয় নিয়েই তাঁরা জঙ্গলে যান। সেদিন মনে ভয় থাকলেও এক সেকেন্ড আগেও বুঝতে পারেননি আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে।
আবু হায়াত বারবার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। চোখের সামনে ঘটা দৃশ্য তো ভুলতে পারছেন না। বলেন, এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি যিনি হননি, তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন না। সেদিন এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা হতে পারত, তা মনে করলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন আবু হায়াত। বলেন, আল্লাহই এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা।
আবু হায়াতের নিজের কোনো জমি নেই। খাসজমিতে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। দরিদ্র পরিবার বলে ঋণের বোঝা তো মাথায় আছেই।
আবু হায়াত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। মাছ ধরা ছাড়া আয়ের আর কোনো পথ নেই। কাজ করতে না পারলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে তাঁকে।
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কৈখালী স্টেশন কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ ব্যাপারী ঘটনার পর প্রথম আলোকে জানান, বাঘের হামলার শিকার আবু হায়াত ঢালীসহ তিনজন গত ২৯ জানুয়ারি মাছ ধরার অনুমতি নেন সুন্দরবন যাওয়ার জন্য।
ঘটনার পর আবু হায়াতকে দেখতে গিয়েছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা এলাকার মানুষের কাছে ‘টাইগার গনি’ নামে পরিচিত আবদুল গনি।
২০০৭ সাল থেকে সুন্দরবন এলাকায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও উদ্ধারকারী হিসেবে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। টাইগার রেসপন্স টিমের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ফরেস্ট নেতা হিসেবে কাজ করেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত। এ পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে জীবিত ও মৃত শতাধিক মানুষকে উদ্ধার ও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তিনি। নিজেও কয়েকবার বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন।
টাইগার গনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আবু হায়াত বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। বাঘ প্রথমেই তাঁদের হাতের টর্চলাইট ও বইঠার আঘাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল বলে পিছিয়ে যায়। বাঘের থাবা থেকে বেঁচে ফেরা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।
ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্টের (আইসিডি) প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান জানান, তিন বছর ধরে খুলনার কয়রা উপজেলায় বাঘের আক্রমণে স্বামী নিহত হয়েছেন—এমন ১৩২ জন বাঘবিধবার কর্মসংস্থানসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। তবে বাঘের আক্রমণে আহত হলে সেই পরিবারের জন্য এখনো সেভাবে কোনো সহায়তা করতে পারছেন না। তবে ভবিষ্যতে আহত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চান। বলেন, বাঘের থাবায় আহত মানুষের মনের ভয় বা ট্রমা কাটাতেই অনেক দিন চলে যায়। আঘাত গুরুতর হলে আবার কাজে ফেরাও কঠিন, এ কারণে পরিবারে ভোগান্তির আর অন্ত থাকে না। আর এসব অঞ্চলে বনজীবী মানুষকে জঙ্গলে গিয়ে মধু সংগ্রহ, মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোনো আয়ের পথও তেমন নেই।
বন্য প্রাণীর মাধ্যমে আক্রান্ত মানুষের জানমালের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সরকার। বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম জানান, গত বছর করা জানমালের ক্ষতিসংক্রান্ত বিধিমালা অনুযায়ী, বন্য প্রাণীর আক্রমণে মারা গেলে তাঁর পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে তিন লাখ টাকা। গুরুতর আহত ব্যক্তি পাচ্ছেন এক লাখ টাকা। এ ছাড়াও ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। আক্রমণের শিকার ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে যথাযথ নিয়মে ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করতে হবে।
আবু হায়াতের সঙ্গে সরকারি অনুমোদন নিয়ে সেদিন মাছ ধরতে গিয়েছিলেন নূর ইসলাম। মুঠোফোনে নূর ইসলাম বলেন, তিনিও এবারই প্রথম বাঘের থাবার সম্মুখীন হন। তবে মনে সব সময় ভয় নিয়েই তাঁদের জঙ্গলে যেতে হয়। প্রায় ৪০ বছর আগে নূর ইসলামের এক মামা বাঘের আক্রমণে মারা যান।