প্রতিবন্ধিতা জয় করলেন তাঁরা
ক্যানসারে স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তান ও বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে অথই সাগরে পড়েন প্রতিবন্ধী পারভিন আকতার। পরিবারের পাঁচ সদস্যের খাবার জোগানো সহজ ছিল না তাঁর মতো চলাফেরায় অক্ষম কোনো মানুষের পক্ষে। তবে পারভিন পারলেন, প্রতিবন্ধকতা জয় করলেন সেলাইয়ের ফোঁড়ে।
ছয় বছর বয়সে টানা পাঁচ দিন ডায়রিয়ায় ভুগে মরতে বসেছিলেন রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ইছামতী এলাকার পারভিন আকতার। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে সেরে ওঠেন তিনি। সুস্থ হলেও দুই পা বেঁকে যায় তাঁর। বয়স বাড়তে থাকলে অন্যের ওপর নির্ভরশীরতাও বাড়ে পারভিনের। বিয়ের পর তাঁর পঙ্গুত্ব মারাত্মক আকার ধারণ করে।
ছয় বছর আগে তাঁর স্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একরকম অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। সে সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস (এওয়াক)। পারভিন আকতারকে সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে একটি সেলাই মেশিন বিনা মূল্যে প্রদান করে সংস্থাটি।
সম্প্রতি পারভিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেলাই মেশিনে কাজ করছেন তিনি। কাপড় সেলাই ছাড়াও বেত দিয়ে মোড়া বানিয়েও বাড়তি আয় হচ্ছে বলে জানালেন। সংসারে এখন কাউকে অভুক্ত থাকতে হয় না। মেয়ে তানজু পড়ছে সপ্তম শ্রেণীতে এবং ছেলে ফাহিম প্রথম শ্রেণীতে।
মরিয়মনগর ফুলগাজীপাড়ার আবদুল লতিফও (৫৮) টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পা হারিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের বোঝা হয়ে থাকাতে চাননি তিনিও। ছয় মেয়ে ও এক ছেলের সংসারে অভাব লেগেই ছিল। তবে বেসরকারি সংস্থা এওয়াকের সহায়তা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনিও। সংস্থাটির প্রতিবন্ধী-সহায়ক প্রকল্প থেকে একটি ট্রাইসাইকেল পেয়েছেন। এই সংস্থা থেকে বিনা সুদে ঋণ নিয়ে দোকানও দিয়েছেন তিনি। এখন প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয় তাঁর। পা না থাকলেও লতিফ দিব্যি সমালাচ্ছেন সংসার। রাঙ্গুনিয়ার পূর্ব সৈয়দবাড়ি এলাকার বাকপ্রতিবন্ধী মমতাজ বেগমের (২২) কাহিনিও এমন। বিয়ের এক বছর পর স্বামী চলে যান মমতাজকে ছেড়ে। পরিবারে মা ও ছয় বছর বয়সী ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। এওয়াকের কাছ থেকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ ও বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন পেয়ে মমতাজ এখন পরিবারের হাল ধরেছেন।
রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন এলাকার সাতজন নারী ও ৩০ জন পুরুষ প্রতিবন্ধী বেসরকারি সংস্থার সহায়তা পেয়ে এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। নারীদের প্রত্যেকেই সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। আর পুরুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জড়িত হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়।
এওয়াকের প্রকল্প কর্মকর্তা সমীর বড়ুয়া জানান, রাঙ্গুনিয়ার প্রতিবন্ধী নারীরা প্রশিক্ষণ, সেলাই মেশিন ও বিনা সুদে ঋণ পেয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অপর দিকে পুরুষ প্রতিবন্ধীরা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। রাঙ্গুনিয়ার এসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আয় দিয়ে চলছে তাঁদের পরিবার। তাঁদের এই সাফল্য এলাকাবাসীর জন্য অনুপ্রেরণার।
এওয়াকের নির্বাহী প্রধান সফিউল আজম সিরাজী জানান, এলাকার প্রতিবন্ধী লোকজনের শারীরিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে থেরাপি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাশাপাশি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়েও তাঁদের সহায়তা করা হচ্ছে।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম মজুমদার জানান, রাঙ্গুনিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিশেষ করে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।