রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনার যেকোনো পর্যায়ে, যেকোনো কারণে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশকে নিতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সরবরাহকারী রাষ্ট্র রাশিয়া দুর্ঘটনার কোনো দায় নেবে না।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে কোনো বিপর্যয় ঘটলে কিংবা কেন্দ্রটির জন্য সরবরাহ করা পারমাণবিক জ্বালানি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার পর তা থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব বাংলাদেশকেই নিতে হবে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে সাধারণ চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সই হয়েছে, তার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব নিরূপণের (নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি) বিষয়ে এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর রাতে উভয় পক্ষ এই চুক্তিতে সই করে। এটিই হচ্ছে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রধান চুক্তিপত্র। এ ছাড়া অন্যান্য যে চুক্তি বা প্রটোকল দুই দেশের মধ্যে সই হবে, তার সব কটিই সাধারণ চুক্তিকে সমর্থন করে। অর্থাৎ সাধারণ চুক্তিটিই হলো সব চুক্তির ভিত্তি।
জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং রূপপুর প্রকল্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব (নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি) নিরূপণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) একটি বিধান (প্রটোকল) রয়েছে। তাতেই বলা হয়েছে, প্রকল্পের মালিক বা স্বত্বাধিকারী দেশকেই পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে। স্বত্বাধিকারীরা যাতে ভালোভাবে বুঝেশুনে প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেয়, তা নিশ্চিত করাই আইএইএর ওই প্রটোকলের উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সূত্র জানায়, সাধারণ চুক্তিতে যা-ই থাকুক, এ কথা সবাই বোঝেন, বর্তমান পর্যায়ে কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশের কিছুই করার থাকবে না। একইভাবে ভালোমতো বুঝেশুনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কিংবা নির্মাতা ও সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের দুর্বলতা আছে।
ওই সূত্র জানিয়েছে, আইএইএর ওই প্রটোকলের একটি দুর্বলতা হলো, পারমাণবিক দুর্ঘটনার কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী বা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারীর ত্রুটি হলেও তার দায় তাদের বহন করতে হয় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্বত্বাধিকারীর ওপরই দায় বর্তায়। যাতে এই দুর্বলতার শিকার হতে না হয়, সে জন্য ভারত একটি আইন করেছে।
ওই আইনের বিধান বলছে, ভারতে যেসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে, সেগুলোর যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী বা নির্মাণকারীর ত্রুটির কারণে কিংবা যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত নিম্নমানের কাঁচামালের কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তার দায় স্বত্বাধিকারীর ওপর বর্তাবে না। সরবরাহকারী ও নির্মাণকারীর ওপর বর্তাবে। এই আইন করার পর রাশিয়া ভারতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনীহা প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনা চলে। শেষ পর্যন্ত ভারতের আইন মেনেই রাশিয়া সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহে রাজি হয়।
পারমাণবিক সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশেরও এমন একটি আইন করা উচিত কি না, কিংবা সরকার তেমন কিছু ভাবছে কি না জানতে চাইলে সূত্র জানায়, আইন করলেই যে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ভারত যেটা পেরেছে, বাংলাদেশও বর্তমান পর্যায়ে সেটা পারবে, তা না-ও হতে পারে। বাংলাদেশ তেমন আইন করলে রাশিয়া বা অন্য কোনো দেশ হয়তো এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাজি হবে না।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের মতো সুরক্ষা আইন বাংলাদেশেরও অবশ্যই করা উচিত। সরবরাহকারী ও নির্মাতারা এ ধরনের আইন মানতে চাইবে না, এমন ধারণা থেকে আমরা তো অরক্ষিত থাকতে পারি না। দক্ষতার সঙ্গে দর-কষাকষি (নেগোশিয়েশন) করতে পারলে আইন মেনেই কাজ করতে বাধ্য হবে সরবরাহকারী ও নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলো।