পাচার হওয়া দুই বোনের দেখা ভারতের যৌনপল্লিতে
লাবণী-পারুল (ছদ্ম নাম) দুই বোনের দেখা হওয়ার কথা ছিল যশোরের এক গ্রামে অথবা ঢাকায়। অথচ দেড় বছর পর দেখা হয়েছে ভারতের মুম্বাইয়ের যৌনপল্লিতে।
দুজনের কেউই জানত না, অন্য বোনটি তার মতোই পাচার হয়েছে। আশ্চর্য এই সাক্ষাৎপর্ব বিস্ময়ের চেয়ে বেশি বেদনার। মাত্র ১৪ বছরের ছিপছিপে শ্যামলা মেয়ে লাবণী আক্তার সব সময় চোখে কাজল পরতে ভালোবাসত। বাড়ির সামনে কাকচক্ষু জলের পুকুরে দাপিয়ে বেড়ায়। এই মেয়ের জীবন মাত্র কয়েক দিনে বদলে গেছে পুরোপুরি। লাবণী এখন জানে, সব ইচ্ছের মৃত্যুর পরও মানুষ বেঁচে থাকে।
এই অন্ধকার গহ্বর থেকে নিজেই দু-একবার পালাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এবার সে গুজরাট থেকে পালিয়ে মুম্বাই পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। গুজরাটের যৌনপল্লিতে বাংলাদেশের এক নারীর সঙ্গে পরিচয়ের পর আশ্বস্ত করেছিল, দেশে পৌঁছে দেবে। সে ভরসায় ঝুঁকি নিয়েছিল লাবণী। কিন্তু মুম্বাই এসেই বুঝেছে, সে শুধু হাতবদল হয়েছে।
হাতবদলের ঘটনা শুরু হয়েছে মাত্র দেড় বছর আগে অন্ধকারের ভেতর কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রমের সময় থেকেই। বেনাপোলে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে অন্য ভূখণ্ডে নিজের শরীর গুঁজে দেওয়ার সময় লোহার খোঁচায় পা রক্তাক্ত হলেও হাঁটা থামাতে পারেনি। তখন আর ফেরার উপায় নেই পাচারকারীদের কবল থেকে। দুই বোনের বাড়িই যশোরের এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে বেনাপোল স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। ওদের গ্রামে বাল্যবিবাহের প্রবণতা যেমন বেশি, আবার ভারতে পাচারের ঘটনাও হরহামেশা ঘটে।
কিশোরী থাকতে বিয়ে হওয়া বড় বোন পারুলের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছিল। গৃহকর্মী হিসেবে রাজধানীতে কাজ করে। ২০১৩ সালে ছোট বোন লাবণী ভালো ফল করে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। বড় বোনের পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পড়ালেখা ছাড়বে না। এর মধ্যে ওর স্কুলে এক-দুজন করে কমতে শুরু হয় সহপাঠীর সংখ্যা। তাদের বিয়ে হয়ে যায় অল্প সময়ের ব্যবধানে। যশোরে সুমাইয়া নামের সহপাঠীর বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিচয় রাজধানীর মিজান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। একপর্যায়ে হয় ফোন নম্বর আদান-প্রদান।
কিছুদিন পরই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা বিয়ে ঠিক করলেন লাবণীর। ওর মনে হলো, রাজধানীতে একবার পৌঁছাতে পারলে সে নিজের বিয়ে ঠেকাতে পারবে। পোশাকশ্রমিক হিসেবে একটা কাজ খুঁজে পেলেও চালিয়ে যেতে পারবে নিজের পড়ালেখা। তা ছাড়া বড় বোন তো ওই শহরেই আছে। এর মধ্যে দু-একবার মুঠোফোনে কথা হয়েছে মিজানের সঙ্গে। খোঁজখবর নিতে ফোন করেন মিজান। এবার লাবণী নিজেই ফোন করে রাজধানীতে একটি কাজ খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ জানাল।
দুই দিনের মধ্যে আশ্বস্ত করে মিজান জানালেন, চাকরি পাওয়া গেছে। তবে রাজধানীতে একা আসা কিশোরীর জন্য অনিরাপদ। তাই যশোর থেকে সে নিজেই নিয়ে এসে পৌঁছে দেবে বড় বোন পারুলের কাছে। লাবণীকে শুধু যশোর সদর পর্যন্ত আসতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছাত্রী কখনো ঢাকায় আসেনি। কথামতো ব্যাগ গুছিয়ে যশোর এসে অপেক্ষারত মিজানের সঙ্গে শুরু হলো লাবণীর যাত্রা। মাত্র ঘণ্টা দেড় পরই বাস গন্তব্যে পৌঁছালে অবাক হয়েছিল। পদ্মা নদী পার হতে হলো না, গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের নাম শুনল না, অথচ পৌঁছে গেছে! এর মধ্যে সে অন্ধকারেও আবছা দেখেছে, সবুজ সাইনবোর্ডে লেখা বেনাপোলের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। পাশের সিটে বসে থাকা মিজানের মুঠোফোনের আলাপ থেকে সন্দেহ আরও পোক্ত হয়।
সকাল হতেই তাকে সাজগোজ আর গায়ে সেঁটে থাকা কাপড় পরে রোজ তৈরি হতে হয়। ঠিক এমন সময় স্কুলের পোশাক গায়ে সে বান্ধবীদের সঙ্গে বইখাতা নিয়ে মাঠের হালট ভেঙে ক্লাস করতে যেত। এখন একজনের পর একজন ‘কাস্টমার’ তাকে বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে যায়। উপার্জনের টাকাটা যায় দালালের হাতে।
বেনাপোল সীমান্তের কাছে এক বাড়িতে নিয়ে গেলে লাবণী দেখল, আগেই ওখানে নিয়ে আসা হয়েছে আরও সাত কিশোরীকে। কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা, এরপর শুরু হলো তাদের হাঁটা। ওদের আটজনকে নিয়ে রওনা হলো দুই পাচারকারী, যার মধ্যে একজন সেই মিজান। চোরাই পথে ওপাশে পৌঁছানোর পর তাদের নিয়ে যাওয়া হলো আরেকটি বাড়িতে। সেখানে একজন মাঝবয়সী নারী সবার ওপর কর্তৃত্ব খাটান। তাঁর হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হলো নবাগতদের। এ সময়ই সে প্রথম জানতে পারে, যৌনকর্মী হিসেবে এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে সে। আগে থেকে এ বাড়িতে ছিল বাংলাদেশের আরও কয়েকজন মেয়ে। যাদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়, আবার রাতে ওরা ফিরে আসে।
এর মধ্যে লাবণীর পা ফুলে হয়েছে কলাগাছের মতো। ব্যথায়, ভয়ে এবং জীবনের এমন আকস্মিক বিপর্যয়ে পুরোপুরি বিপর্যস্ত সে ততক্ষণে। সে ভাত খাওয়া বন্ধ করেছে প্রথম রাত থেকেই। ক্রমাগত অসহনীয় হয়ে উঠছে পায়ের যন্ত্রণা। কিন্তু সবই এখন ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সীমান্তঘেঁষা ভারতের ওই বাড়ি থেকে দুই দিন পর গুজরাটের উদ্দেশ্যে ওকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেকটি বহরের সঙ্গে। ফলে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা অন্য মেয়েদের সঙ্গেও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়। গুজরাট পৌঁছানোর পর প্রথম দুই মাস লাবণীকে দিয়ে অন্য মেয়েদের বসে থাকা কাজের ফাইফরমাশ করানো হচ্ছিল। এ সময় নিয়মিত কয়েক রকম ওষুধ খাওয়ানো হতো। পায়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক বলা হলেও ওর ধারণা, এর মধ্যে অন্য ওষুধও ছিল। দ্রুত শরীর ফুলে উঠছিল, বাড়ছিল ঝিমুনি।
অনেক দূর পড়তে চাওয়ার স্বপ্ন দেখা লাবণীর পায়ের ব্যথা কমতেই শুরু হয়েছিল জীবনের সেই অন্ধকার পর্ব। সকাল হতেই তাকে সাজগোজ আর গায়ে সেঁটে থাকা কাপড় পরে রোজ তৈরি হতে হয়। ঠিক এমন সময় স্কুলের পোশাক গায়ে সে বান্ধবীদের সঙ্গে বইখাতা নিয়ে মাঠের হালট ভেঙে ক্লাস করতে যেত। এখন একজনের পর একজন ‘কাস্টমার’ তাকে বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে যায়। যে উপার্জনের টাকা যায় দালালের হাতে। ফলে সুযোগ বুঝে মুঠোফোনে বাংলাদেশে ফোন করার কোনো সুযোগও নেই।
দরজির দোকানের পাশেই আবছা ভেজানো এক ঘর। সে ঘরও আরেক যৌনপল্লি। সেখান থেকে বের হয়ে এসে রোয়াকের পাশে বসলেন এক নারী। তাঁর সাজসজ্জা, পোশাকে রঙের বাহার অথচ মুখে ঘোর বিপর্যয়ের ছাপ। লাবণী ঘাড় ঘুরিয়ে অজান্তে তাকিয়েছিল সেদিকে। বিস্ময়ে থমকে গেছে।
প্রতিদিন তাকে দুই থেকে তিনটি হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হতো ভিন্ন ভিন্ন বয়সী কাস্টমারদের কাছে। অনিচ্ছা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। মাত্র ১৩ বছরের কিশোরীর কাছে নেই পাসপোর্ট। অবৈধ প্রবেশকারী হিসেবে পুলিশ যখন-তখন জেলে ভরতে পারে, ফলে পথে একা চলাফেরা সম্ভব নয়। ভয় দেখানো হয়েছে, এ দেশের জেলে একবার ঢুকলে মৃত্যুও সেখানেই হবে। যশোরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরীর জীবনের গল্প বদলে গেল একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য। বাংলাদেশের শত শত লাবণী এমন ভুল করেছে অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস করে।
যশোরে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অফিসে বসে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপের সময় লাবণী বলছিল, ‘গুজরাটে যেদিন প্রথম বাধ্য করা হয়েছিল, সেদিন অনেকবার মনে হয়েছে আত্মহত্যা করি। পায়ের ঘা থেকে মরে গেলেও ভালো হতো। ২০১৩ সালে এত ছোট ছিলাম যে পালানোর বুদ্ধিটাও ভালোভাবে করতে পারিনি। অথচ আমি তো আরও পড়ব বলে বাবা-মায়ের ঠিক করা বিয়ে থেকে পালিয়েছিলাম।’
গুজরাটে আট মাস যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে সে। এরপর আবার ঠিকানাবদল। গুজরাটে এক নারী তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, দেশে ফেরার সুযোগ করে দেবেন। অথচ মুম্বাই গিয়ে আবিষ্কার করল, আবারও ওর স্থান যৌনপল্লিতে। এবার ওর ভয় কিছুটা কমেছে। প্রতিবাদ করলে বলা হলো, দেশে ফিরতে টাকা প্রয়োজন হবে, সে টাকা ওকেই উপার্জন করতে হবে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের রোজার ঈদ এল। ঈদের সময় সে পল্লির কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হলো নতুন জামা বানাতে দরজির দোকানে। এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত লাবণী জানত না কী অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
সে দরজির দোকানের পাশেই আবছা ভেজানো এক ঘর। সে ঘরও আরেক যৌনপল্লির এলাকা। সেখান থেকে বের হয়ে এসে রোয়াকের পাশে বসলেন এক নারী। তাঁর সাজসজ্জা, পোশাকে রঙের বাহার অথচ মুখে ঘোর বিপর্যয়ের ছাপ। লাবণী ঘাড় ঘুরিয়ে অজান্তে তাকিয়েছিল সেদিকে। বিস্ময়ে থমকে গেছে। নিজের আপন বড় বোন রাজধানীর গৃহশ্রমিক পারুল। যার কাছে পৌঁছাবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল মিজান নামের মানুষটির সঙ্গে। দুই বোনের এই নাটকীয় দেখার গল্প এখানে শেষ হতে পারত। সে মুহূর্তে বাজারের মতো এলাকায় শুরু হলো পুলিশের অভিযান। দুই বোনসহ কয়েকজনকে একসঙ্গে ধরে এনে রাখা হলো পুলিশের হেফাজতে। এরপর দুই বোনকে দুই সেফ হোমে।
দুজনই দেশে ফিরেছে জীবন থেকে চার-পাঁচ বছর সময় হারিয়ে। লাবণী ভারতের একটি সেফ হোমে ছিল তিন বছর। ‘জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার’ নামের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মধ্যস্থতায় ২০১৬ সালে দেশে ফিরেছে সে। পাচার হয়েছিল ২০১৩ সালের জুন মাসে। এরপর শুরু হলো টিকে থাকার, সমাজের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার সংগ্রাম। যশোর সদরের আরবপুরে ‘বাঁচতে শেখা নামে’ আরেকটি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল ওর সঙ্গে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ ভেঙে মেয়েটি এসেছিল নিজের জীবনের গল্প শোনাতে। জানাল, বাড়ি থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে, গণপরিবহনে এসে আবার শেয়ারের অটোতে করে পৌঁছেছে। কিন্তু নিজের জীবনের গল্পটা সে বলতে চায় অন্যদের জন্য।
বাড়ি ফেরার পর আশপাশের মানুষ প্রায় একঘরে করেছিল পুরো পরিবারকে। দুই মেয়েকে হারিয়ে তত দিনে সচেতন হয়েছেন ওদের বাবা। ভেবেছিলেন আর দেখা হবে না মেয়েদের সঙ্গে। দুই মেয়েকেই অল্প বয়সে বিয়ে দিতে চেয়ে প্রথম ভুলটা তিনিই করেছেন বলে মুঠোফোনে স্বীকার করলেন এই পিতা। দেশে ফেরার পর বড় মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো নড়াইলে নানাবাড়িতে। কিছুদিন ঘর থেকে বের হতো না লাবণী। এরপর আস্তে আস্তে শুরু হলো ওর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পাচারকারীর হাতে পড়েছিল লাবণী আক্তার। এরপর এসএসসি, এইচএসসি পাস করেছে ভালো ফল নিয়ে। এখন অনার্স পড়ছে সে। কম্পিউটার শিখেছে। শখ করে পুঁতি দিয়ে গয়না বানানো ওর শখ। নিজের জামায় নিজেই নকশা তোলে। মাঝেমধ্যে পুকুরের পাশে গিয়ে বসে। পুরোনো দিনের কথা মনে করে না।
ভবিষ্যতে কী হতে চাও জিজ্ঞেস করেছিলাম। জানাল, যে কাজই করুক তাতে যেন কিশোরীদের মানসিক উন্নয়নের জন্য পরামর্শ দেওয়ার সম্পর্ক থাকে। এরই মধ্যে সে কয়েকটি পরামর্শ সভায় বক্তা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। কোনো কিশোরী যেন আর ওর মতো ভুল না করে, সে জন্য কাজ করতে চায় সে।
ফিরে আসার আগে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি তো চোখে কাজল দিতে ভালোবাসো বলছিলে। এখন নেই কেন? বলল, ‘আমি তো দু-একজন ভাগ্যবানের একজন। ফিরে এসে আবার নিজের জীবন শুরু করতে পেরেছি। পাচার হওয়া শত শত কিশোরী এখন গুজরাট, মুম্বাইয়ে আছে, যারা আর কোনো দিন ফিরতে পারবে না। মাস্টার্স পাস করে যেদিন চাকরি করে বেতন পাব, সেদিন আবার চোখে কাজল দেব।’