পদ্মা সেতু একটি যুগান্তকারী বিষয়
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান। শুধু পদ্মা সেতু নয়, স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই তিনি কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল ৭৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। পদ্মা সেতু নিয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক সাময়িকী ‘বিজ্ঞানচিন্তা’র মে ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। আজ ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে পদ্মা সেতু। এ দিনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
প্রশ্ন :
পদ্মা সেতু নির্মাণে মূল চ্যালেঞ্জ কী?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমাদের দেশের জন্য বড় বড় নদীর ওপর সেতু তৈরিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রিভার ট্রেইনিং। অর্থাৎ নদীশাসনের মাধ্যমে নদীটির গতিপথ স্থিতিশীল করে সেতুর নিচ দিয়ে যাতে প্রবাহিত হয়, তা নিশ্চিত করা। কাজটি ভালোভাবে করা না হলে দেখা যাবে, সেতু যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে। অন্যদিকে নদী তার পথ বদলে সেতুকে পাশ কাটিয়ে অ্যাপ্রোচ রোডকে প্লাবিত করে বা ভেঙে ফেলে সেতুর কাঠামোটা নষ্ট করে ফেলবে। তাই নদীশাসন এ কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমাদের দেশের নদীগুলো আবার ভিন্ন প্রকৃতির সমস্যার জন্য পরিচিত। এগুলো যেমন তীব্র স্রোতে এগিয়ে চলে, তেমনি পাড় ভাঙার (ইরোশন) কারণে প্রতিবছর নদীর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। অধিকাংশ নদী তাদের অবস্থান খুব অল্প সময়েই পরিবর্তন করে ফেলে। নদীগুলোর প্রকৃতিও আলাদা। কিছু নদী সর্পিলাকার, এঁকেবেঁকে চলাচল করে। এদের বলে মিয়েন্ডারিং। পদ্মা একটি মিয়েন্ডারিং নদী।
প্রশ্ন :
নদীশাসনের জন্য এখানে কি নতুন কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: পদ্মা সেতুর নদীশাসন করতে গিয়ে যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, তার নাম ‘গাইড বান্ড উইথ ফলিং অ্যাপ্রোন’। এ ক্ষেত্রে নদী পাড় থেকে যত দূর খনন করা যায়, তা করে রাখা হয়। আধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে ২০-২৫ মিটার পর্যন্ত খনন করে স্লোপ বা ঢাল তৈরি করা হয়। এর ওপর ভারী পাথর ফেলে রাখা হয় কিংবা অনেক সময় জিও টেক্সটাইলের বালুভর্তি ভারী ব্যাগ ফেলে রাখা হয়। ফলে ওই অংশের নরম মাটি যদি কোনো কারণে ভেঙে নিচে সরেও যায়, তাহলে ওই ভারী পাথর বা ব্যাগ আরও নিচে পড়ে গিয়ে শক্ত স্তর সৃষ্টি করে, যা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে বাধার সৃষ্টি করবে।
প্রশ্ন :
পাইলিংয়ের ক্ষেত্রে নতুন কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: পদ্মা সেতুর পাইলিং খনন এখন প্রায় ১২২ মিটার, যা নদীতে সেতুর কাঠামো নির্মাণে বিশ্বের গভীরতম পাইলিং। এটি প্রায় ৪০তলা বিল্ডিংয়ের উচ্চতার সমান। ৩ মিটার ব্যাসের এই ইস্পাতের টিউবকে কিছুটা বাঁকাভাবে হ্যামার দিয়ে মাটিতে ঢোকানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে প্রতিটি পিলারের নিচে দু-তিনটি করে পাইলিং করা আছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারের নিচে পাইলিং আছে ছয়টি করে।
প্রশ্ন :
সেতুটি একটু বাঁকানো, কেন?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: সেতুটি যদি আমরা আকাশ থেকে দেখি, তাহলে বোঝা যায়, সেতুটি ডাবলি কার্ভড, অর্থাৎ ডানে-বাঁয়ে দুবার সামান্য বাঁকানো। এটি মূলত করা হয় চালকদের কথা চিন্তা করে। একদম সোজা সেতু হলে চালকেরা সেতুতে উঠে আর ড্রাইভিংয়ে নজর রাখেন না। ঝিমুনি আসে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। কিন্তু একটু বাঁকানো হলে চালকদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়।
প্রশ্ন :
ভূমিকম্প হলে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: এ সেতুকে ভূমিকম্পসহনীয় করতে অনেক কাজ করা হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে একটি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ভূমিকম্পের সময় মাটির যে কম্পন তার সব যাতে সেতুর উপরিকাঠামোতে যেতে না পারে, তার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এটি ব্যবহার করলে ভূমিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতুর কাঠামোতে এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না। ডিজাইন অনুসারে এটি প্রায় ১০ হাজার টন লোড সামলাতে সক্ষম।
প্রশ্ন :
একসময় ধারণা করা হতো, বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ এ ধরনের বড় প্রকল্প করতে পারবে না। কিন্তু এখন আমরা নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের কাজে সফলতা পাচ্ছি। বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: পদ্মা সেতুর পুরো বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থায়নে। আমি বলব, এটা বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী বিষয়। আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা এখন এত বড় একটা কাজে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। আশা করছি, আমরা যথাসময়ে এ কাজ শেষ করতে পারব। তাহলে ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় প্রকল্প হাতে নিতে পারব। আমি মনে করি, আমাদের অভিজ্ঞতা কম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যেখানে ঘাটতি, সেই অংশের জন্য আমরা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনতে পারি। তবে বাদবাকি যেসব কাজ আমরা আমাদের মতো করতে পারি, সেগুলোতে আমাদের দেশীয় প্রকৌশলীদের সুযোগ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের এসব কাজ ফিডিক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়মাবলি অনুসরণ করে পরিচালনা করা হয়। আমাদের এসব নিয়মাবলি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
প্রশ্ন :
ভবিষ্যতে এ রকম বড় কোনো প্রকল্পের কথা ভাবছেন?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: ভবিষ্যতে হয়তো যমুনার ওপরে আরও চারটি সেতু প্রয়োজন হবে। পদ্মার ওপরেও আরও দুটি সেতু লাগবে। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে যান চলাচল বাড়বে। তখন এত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের আরও বেশি সেতু ও সড়কের প্রয়োজন পড়বে।