পতপত করে উড়ত স্বাধীন বাংলার পতাকা

বিজয়ের মাস
বিজয়ের মাস

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই যেসব অঞ্চল মুক্ত হয়েছিল, কেমন ছিল সেসব অঞ্চলের পরিবেশ, মানুষের আবেগ-অনুভূতি? এ রকম ১৬টি এলাকার আনন্দ-বেদনার দিনলিপি গ্রন্থিত হয়েছে বিজয়ের মাস–এ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময় রৌমারী ছিল মুক্তাঞ্চল। কুড়িগ্রাম জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে বিচ্ছিন্ন থাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বারবার চেষ্টা করেও রৌমারীর মাটিতে পা দিতে পারেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময় রৌমারী ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখানে পতপত করে বাংলাদেশের পতাকা উড়ত। মানুষ বুক ফুলিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াত।
রৌমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল কাদের বলেন, ‘রৌমারী মুক্ত এলাকা হওয়ায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ, বগুড়া ও রংপুর থেকে বহু যুবক এখানে এসে ট্রেনিং নিত। প্রথম দিকে আমরা বাঁশের লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করি। এরপর ভারতে চলে যাই। পরে রৌমারীতে ট্রেনিং ক্যাম্প হলে আমরা ফিরে আসি। রৌমারীতে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া অসংখ্য হিন্দু ও মুসলিম পরিবার বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে এসে আশ্রয় নেয়। তারা নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। স্থানীয় মানুষ প্রথম দিকে তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে। অনেক পরিবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।

‘মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন এমএনএ সাদাকাত হোসেন, নুরুল ইসলাম, আজিজুল হক হেডমাস্টার, ব্যবসায়ী নিবারণ সাহা, আবুল ফজল প্রমুখ। পরে এখানে অস্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থাও চালু করা হয়। এ প্রশাসনের আওতায় পোস্ট অফিস ও ডাক বিভাগ চালু হয়। বলা যায়, এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট অফিস। এ ছাড়া থানা ও হাসপাতাল স্বাভাবিক গতিতেই চালু ছিল।’
সাবেক শিক্ষক মো. শাহাবুদ্দীন বলেন, রৌমারী ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই মুক্তাঞ্চল থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক অগ্রদূত নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রৌমারী সিজি জামান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজিজুল হক। তাঁকে সহায়তা করতেন মতিউর রহমান। সে সময় রৌমারীতে প্রেস না থাকায় হাতে লিখে সাইক্লোস্টাইল করে পত্রিকাটি ছাপানো হতো। লেখা ও মুদ্রণের কাজ করতেন সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ আলী। সংবাদ সংগ্রহ করতেন হারুণ হবীব ও মো. শাহাবুদ্দীন। ১ আগস্ট ১৯৭১ সালে প্রথম সংখ্যা বের হয়। সেই সময় পত্রিকাটি বিভিন্ন রণাঙ্গনের যুদ্ধের খবর প্রকাশ করে ব্যাপক সাড়া ফেলে। রেডিওর খবর ও পত্রিকাটির খবর মানুষ দল বেঁধে শুনত ও পড়ত।
বীর প্রতীক তারামন বিবি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত অঞ্চলটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজীবপুর কোদালকাটিচরে পাকিস্তানি হানাদার রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করতে চেষ্টা করে। সে সময় আলতাফ হোসেন ও সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে কর্ত্তিমারি বাজারে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়। ১৩ আগস্ট তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে ১৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত হয় ২৩-২৪ জন। তারা লাশ রেখে পালিয়ে যায়।’