বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের নারকীয় গ্রেনেড হামলার ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। ওই ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের কোলের শিশুরা অনেকেই এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। যুবকেরা নতুন সংসার গড়েছেন। দল ও সরকারের পক্ষ থেকে দান-অনুদান চলছে। জীবন কেটে যাচ্ছে জীবনের নিয়মে। এর সঙ্গে বুকচাপা কষ্টও আছে। হারানো আপনজনদের কথা মনে পড়লেই ব্যাকুলতা জেগে ওঠে। চোখ থেকে ঝরে জল। বিশেষ করে বছর ঘুরে ২১ আগস্ট এলে হাহাকারে ডুবে যান তাঁরা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলটা বড় একটু ঝাঁকুনি হয়ে এসেছিল আওয়ামী লীগ পরিবারে। মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলায় ২২টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে। সেই ঝড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল অনেক স্বপ্নও। বছর ঘুরে আজ সেই দিন ফিরে এসেছে। কেমন আছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা?
গ্রেনেড হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি হতাহত মানুষের প্রতিটি পরিবারের প্রতি যথাসাধ্য সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছেন। হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা, ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসা ও ওষুধপথ্যের জোগাড়, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট বা সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয় নির্বাহসহ সব চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে মিরপুরে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। আহত কেউ কেউ হয়েছেন সাংসদ। অনেককে বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী করা হয়েছে।
চোখ থেকে ঝরে জল। বিশেষ করে বছর ঘুরে ২১ আগস্ট এলে হাহাকারে ডুবে যান তাঁরা।
মা-বাবাহারা দুই ভাইয়ের একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত
দুই ভাই সোহেল মুন্সী ও রাসেল মুন্সী। বাবা মারা যান ছোটবেলায়। মা-ই ছিলেন তাঁদের অভিভাবক। সুফিয়া বেগম হাজারীবাগ মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন। দলীয় কোনো কর্মসূচিই বাদ দিতেন না। সেদিন আইভি রহমানের কাছাকাছিই ছিলেন। গ্রেনেড হামলার পর ছিটকে পড়েছিলেন বাটা শোরুমের সামনের নালায়। প্রাণ হারান সেখানেই। মা মারা যাওয়ার পর সোহেল বিয়ে করে সংসার করছেন। কিন্তু রাসেল গত বছর ব্রেইন স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
বড় ছেলে সোহেল মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছোট ভাই এখন লাঠিতে ভর করে ঘরের মধ্যেই উঠে দাঁড়াতে পারেন। চিকিৎসা চলছে। আশা করছেন, স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। তিনি জানান, মাকে হারানোর পর তাঁরা দুই ভাইকে দুই দফায় চার লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। এরপর দুই ভাইকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়। আরেকবার দুজনকে ১০ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। আরও টুকটাক আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায় দলের নেতাদের কাছ থেকে। সর্বশেষ মিরপুর ১৩ নম্বরে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। এখনো সেখানে ওঠা হয়নি। তবে কাজ শেষ পর্যায়ে।
মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে সোহেল বলেন, গ্রেনেড হামলার পর হঠাৎ তাঁর ফুপাতো বোন এসে বলেন, শেখ হাসিনার সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছে। অনেকে আহত-নিহত হয়েছেন। এরপরই মনে কুডাক দেয় তাঁর। দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকেন। পল্টনের দিকে রওনা দেবেন—এমন সময় আত্মীয়রা জানান, আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে আছেন। তাঁর মাও আহত। আসলে তাঁর মা হামলাস্থলেই মারা যান। মৃত অবস্থাতেই হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ছোট ভাই এখন লাঠিতে ভর করে ঘরের মধ্যেই উঠে দাঁড়াতে পারেন। চিকিৎসা চলছে। আশা করছেন, স্বাভাবিক হয়ে যাবেন।সোহেল মুন্সী, হাজারীবাগ মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী সুফিয়া বেগমের ছেলে
মোস্তাকের সাংসদ হওয়ার শখ ছিল
মোস্তাক আহমেদ ওরফে সেন্টু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলেন। বরিশালের হিজলা-মুলাদি থেকে নির্বাচনও করার আগ্রহ ছিল। এ জন্য এলাকায় নিয়মিত যেতেন। ১৫ আগস্টও মুলাদি গিয়েছিলেন। বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণও বিতরণ করেন।
মোস্তাকের স্ত্রী আইরিন সুলতানা বলেন, তাঁদের বিবাহবার্ষিকী ২২ আগস্ট। ২১ আগস্ট সকালে বের হওয়ার সময় মোস্তাক বলেন, এলাকায় গিয়ে টাকাপয়সা খরচ হয়ে গেছে। বিবাহবার্ষিকীতে কিছু করা যাবে না। তবে রাতে একটু আগেই বাসায় চলে আসবেন বলে জানান। আইরিন বলেন, ‘বাসার ফ্রিজে যা ছিল, তা দিয়ে একটু ভালো রান্নাবান্না করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সন্ধ্যার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।’
সেদিনের দুর্বিষহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আইরিন বলেন, সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করে এক আত্মীয়ের ফোন পান তিনি। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যেতে তাগাদা দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীরগেট পর্যন্ত আসার পর আর এগোতে পারছিলেন না। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর ভয়ার্ত মানুষের ছুটোছুটি চারদিকে। এমন সময় ওই আত্মীয় পুনরায় ফোন দিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে গেটেই মোস্তাকের কিছু সহযোগীকে দেখতে পান। তাঁরা কাঁদছিলেন। তখনো ঠিক ঠাহর করতে পারেননি, আসলে কী ঘটেছিল?
আইরিন বলেন, ‘হাসপাতালের ভেতরের ফটকে গিয়ে অনেক স্বজনকে দেখতে পেলাম। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন কেউ কেউ। তখনই আমি বুঝে যাই, মোস্তাকই বড় কোনো বিপদে।’ কিন্তু মারা যেতে পারেন, সেটা ভাবতেই পারেননি। বিবাহবার্ষিকীর দিনই মোস্তাককে কবরে শুইয়ে দেওয়া হয়।
মোস্তাক-আইরিনের মেয়ের বয়স ছিল তখন তিন বছর। এখন মতিঝিল আইডিয়ালে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। বাবার কথা উঠলে মা-মেয়ে দুজনেরই কষ্ট বাড়ে। একে অপরের সামনে বিষয়গুলো খুব একটা তোলেন না তাঁরা।
আইরিন জানান, মোস্তাক মারা যাওয়ার পর ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দেন শেখ হাসিনা। মেয়ের পড়াশোনার জন্য বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে অনুদান দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি পান। জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দিয়ে এখন এক্সিকিউটিভ অফিসার হয়েছেন। সম্প্রতি মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মোস্তাক সম্ভাবনাময় নেতা ছিলেন। হয়তো একদিন সাংসদও হতেন। আমার পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবই করেছেন। মোস্তাকের রাজনীতিটা যদি কিছুটা এগিয়ে নিতে পারতাম, তাহলে আরও খুশি লাগত।’
‘হাসপাতালের ভেতরের ফটকে গিয়ে অনেক স্বজনকে দেখতে পেলাম। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন কেউ কেউ। তখনই আমি বুঝে যাই, মোস্তাকই বড় কোনো বিপদে।’আইরিন সুলতানা, মোস্তাক আহমেদের স্ত্রী
আজাদের মেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন
তৎকালীন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মা, ভাই ও পরিবার নিয়ে আবুল কালাম আজাদ বসবাস করতেন বালুঘাট বাজারের পাশে বারানটেক এলাকায়। ওই দিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে যোগ দিতে সকালেই বাসা থেকে বের হন। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রতিদিনই যোগ দেন বলে স্ত্রী মাকসুদা আজাদকে সেদিনও কিছু বলে যাননি।
মাকসুদা সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে স্বামীকে ফোন দিলে বন্ধ পান। এরপর বহুবার চেষ্টা করেও ফোন খোলা পাননি। এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দুশ্চিন্তা ভর করে। সন্ধ্যায় টেলিভিশনে শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ হামলার তথ্য জানতে পারেন। স্বামী নিশ্চিত সমাবেশে ছিলেন ধরে নিয়ে অনেকটা স্তব্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
মাকসুদা বলেন, শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম তাঁদের সঙ্গেই থাকেন। পাঁচ বছরের মেয়ে মাহফুজা আজাদকে শাশুড়ির কাছে রেখে বাইরে ছোটেন তিনি। একপর্যায়ে স্বজনেরা জানতে পারেন, আজাদ ঢাকা মেডিকেলে আছেন, আহত। সেখানে গিয়ে করুণ অবস্থা দেখতে পান। একপর্যায়ে আজাদকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সবাই দেখতে গেছেন আজাদকে। স্বাস্থ্যের একটু উন্নতি হলে বিদেশে চিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সেই সুদিন আসেনি। মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেন ১০ সেপ্টেম্বর।
আজাদের মেয়ে মাহফুজা আজাদের বয়স তখন পাঁচ বছর ছিল। ছেলে আল আমিন আজাদের বয়স ছিল দুই বছর। এখন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ছেলে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায়।
আজাদের পরিবারকে মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। শাশুড়ি–সন্তান নিয়ে আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী সেই ফ্ল্যাটে থাকেন। এর বাইরে পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে দুই সন্তানের পড়াশোনার জন্য দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়।