যেখানেই নাশকতা, সেই এলাকার বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হবে। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের বিচারও করা হবে। এ জন্য ঢাকার পাশাপাশি জেলায় জেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে যেকোনো উপায়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এই বৈঠকের পর গতকাল রাত থেকেই অভিযান শুরু করেছে র্যাব-পুলিশ। রাত ১০টায় উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়ি থেকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকাকে আটক করা হয় বলে দলীয় সূত্র দাবি করেছে। তবে র্যাব ও পুলিশ আটকের কথা স্বীকার করেনি। সাদেক হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী মনিরুল ইসলাম রাতে প্রথম আলোকে জানান, খোকাকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে কোথায় নিয়ে গেছে, তাঁর জানা নেই। খোকার বিরুদ্ধে অবরোধে গাড়ি পোড়ানোসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা আছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, বৈঠকে নিরাপত্তার ব্যাপারে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো হলো: নাশকতায় জড়িত বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত সব মামলায় তাঁদের আসামি করা, সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, নাশকতাকারীদের দেখামাত্র গ্রেপ্তার বা পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজনে গুলি করা, রেললাইনের নিরাপত্তা জোরদার করা এবং চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালানো।
বৈঠকে বলা হয়, রেলের নাশকতার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের দায়দায়িত্বও খতিয়ে দেখা হবে। কোনো জনপ্রতিনিধি এসব সহিংস কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকলে ছাড় দেওয়া হবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, রেলপথমন্ত্রী মজিবুল হক, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে ২৫ নভেম্বর থেকে অবরোধ ও হরতালের কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা তুলে ধরা হয়। এ সময় এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা-ও তুলে ধরা হয়।
বৈঠকের সূত্র জানায়, একটি সংস্থার প্রধান বৈঠকে জানান, পুলিশ ৮০ শতাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পেরেছে। কিছু এলাকায় লোকবল কম থাকার কারণে সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরা ও সীতাকুণ্ডের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এসব এলাকায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা শক্ত না হওয়ায় পুলিশ জনসমর্থন পায়নি। ওই সব এলাকায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়।
সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারকে জানিয়েছে, দেশজুড়ে নানা ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এসব পরিকল্পনার কথা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানতে পারে। বৈঠকে নাশকতাকারীদের নেওয়া এসব পরিকল্পনা তুলে ধরে একটি সংস্থার প্রধান জানান, ২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে বড় ধরনের নাশকতার ছক করা হয়েছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেষ্ট থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এ সময় পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা এসব স্বীকারও করেন।
সূত্রমতে, পুরো বৈঠকে রেলপথে নাশকতা বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়কে এ-সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা তৈরির কথা বলা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, এক হাজার ৪১টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। রেলপথের নিরাপত্তা জোরদার করতে সন্দেহজনক কাউকে দেখামাত্র গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করা ও স্থানীয় নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি করার কথা বলা হয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি করে কমিটি থাকবে। এ কমিটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। তাদের সহায়তার জন্য থাকবেন আনসার বাহিনীর সদস্যরা।
বৈঠকে জানানো হয়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কীভাবে পেট্রলবোমা বানাতে ও ছুড়তে হয় তার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। মুঠোফোন ব্যবহারে নাশকতাকারীরা অনেক রকম নির্দেশনা দিচ্ছেন। অনলাইনে নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। ব্লগ ও ফেসবুকে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধ করার পদক্ষেপের কথা বলা হয়।
বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ভূমি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী আমির হোসেন আমু সাংবাদিকদের জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অত্যন্ত সাফল্যজনক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমের প্রতি অভিযোগ করে বলেন, মিডিয়া প্রকৃত চিত্র তুলে না ধরে মাত্র কিছুসংখ্যক গাড়ি পোড়ানোর চিত্র তুলে ধরছে। গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে দুই হাজার গাড়ি চলাচল করেছে। এ পথে মাত্র নয়টি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। তবে কোনো গণমাধ্যমেই দুই হাজার গাড়ি নির্বিঘ্নে চলাচলের চিত্র উঠে আসেনি। এমন সংবাদ প্রকাশ করা উচিত, যা সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
গণপূর্তমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিরোধী দল আন্দোলন করে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করছে। আমরা বলতে চাই, নির্বাচন যথাসময়ে হবে।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের সতর্ক চিঠি: সাম্প্রতিককালে ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংস ও ক্ষতি করা হচ্ছে। বিশেষ করে রেলে নাশকতা চালানো হচ্ছে, যা রাষ্ট্রবিরোধী গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। এ কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রেললাইন ও সরকারি স্থাপনা অবশ্যই নজরদারি করতে হবে। গতকাল স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ চিঠি পাঠানো হয়েছে।