নাওয়ের কারিগরের দুর্দিন
দশ পুরুষের পথ ধরে নৌকা বানানোর পেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন ছমির উদ্দিন প্রামাণিক (৬৫)। ৫০ বছর ধরে নৌকার কারিগর তিনি। এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক নদী, খাল, বিল। গুরুত্ব কমেছে নদীপথের। কদর কমেছে নৌকারও। নদীর বুকে ডিঙি, সাম্পান, বজরার বদলে এখন দাপিয়ে বেড়ায় যন্ত্রচালিত নৌকা। বাজারে নৌকার তেমন চাহিদা নেই। ফরমাশ না থাকায় বছরের বেশির ভাগ সময় কাজও থাকে না ছমির উদ্দিনের হাতে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতে হয় তাঁকে।
সম্প্রতি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার হাঁসরাজ বাজারে কথা হয় ছমির উদ্দিনের সঙ্গে। সেখানে ছেলে শফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ফরমাশি একটি বজরা নৌকা বানাচ্ছিলেন তিনি। একসময় তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল এই সোনাতলারই চুকাইনগরে। কিন্তু বহু আগেই গ্রামটি যমুনায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন তিনি পাশের পূর্ব তেকানী চুকাইনগর গ্রামের বাসিন্দা।
ছমির উদ্দিন জানান, তাঁর বাবা মফছের আলী ছিলেন নৌকার নামকরা কারিগর। তখন তাঁরা দিনে একটি নৌকা বানাতেন। খরচ পড়ত ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বিক্রি হতো ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। তখন এলাকায় তাঁরা ছাড়াও আরও বহু নৌকার কারিগর ছিলেন। আর চাহিদা না থাকায় এখন সবাই অন্য পেশায়। তিনি আরও জানান, সত্তরের দশক পর্যন্ত নদীপারের মানুষের যাতায়াত, মালামাল পরিবহন এমনকি বিয়েশাদি—সবই হতো নৌকাযোগে। একসময় করতোয়া শুকিয়ে যায়। বাঙ্গালী নদীও। যমুনার বুকে বাড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকার দাপানি। মন্দা নেমে আসে ছমির উদ্দিনদের ব্যবসায়।
নৌকার এই কারিগর বলেন, ‘৩০ বছর আগে বাপ-দাদার ভিটা কারে লিল যমুনা। বউ-ছল লিয়ে ওঠনো পাশের গেরামত। আবার লৌকা বানাবার কাজত হাত দিনো। কিন্তু চাহিদা নাই। কাঠের দাম বাড়েছে। খরচ কুলাত না পারে মহাজনের ঘরত কাজ লিনু।’
শফিকুল বলেন, ‘বর্ষা গেলিই বেকার হয়্যা পড়ি। গোটা বছর খ্যায়া না-খ্যায়া পাড় করি। তাই বর্ষার আশাত চ্যায়া থাকি।’
মহাজন শাহ আলম জানান, নদীতে চলাচলের জন্য নয়, এখন শুধু নৌকা হয় মাছ ধরার জন্য। জেলেরা কেনেন। একটি নৌকায় খরচ পড়ে গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিক্রি হয় পাঁচ থেকে সাত হাজারে। মজুরি হিসেবে ছমির উদ্দিন পান দেড় হাজার। মহাজন আরও জানান, বাজারে এই বাপ-বেটাই শুধু নৌকার কারিগর। বছরে দুই মাসের বেশি তাঁদেরও কাজে নামানো সম্ভব হয় না।