দেশে ১০ অ্যান্টিবায়োটিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে
অ্যান্টিবায়োটিক জীবনদায়ী ওষুধ। অযৌক্তিক ব্যবহারে ওষুধটি অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি হাসপাতালে করা গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোতে সতর্কভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। বেশি ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ে কাজে আসছে না।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি। অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে গবেষকেরা বলেছেন, পরীক্ষাগারে নিয়মিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে, যেন চিকিৎসকেরা রোগীর জন্য সঠিক ওষুধের নাম ব্যবস্থাপত্রে লিখতে পারেন।
অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধটি অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে-বিদেশে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেও রোগী সুস্থ হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশে নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা মহামারির মতো বিপজ্জনক। এই কারণে একটি দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়লে সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা থাকবে না।
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকর হওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা আমরা দেখতে পেয়েছি। ব্যবহার করার মতো কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক যদি হাতে না থাকে, সবই যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে সমস্যা গভীরতর হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। ‘সচেতনতা ছড়িয়ে দিন, অকার্যকারিতা রোধ করুন’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সপ্তাহটি পালিত হচ্ছে।
ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সচেতনতার বিকল্প নেই। এই সচেতনতা দরকার সাংসদদের মতো নীতিনির্ধারকদের, স্বাস্থ্য ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের, হাসপাতাল ব্যবস্থাপকদের, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের, ব্যবস্থাপত্র যাঁরা লেখেন, সেই চিকিৎসকদের, ওষুধের দোকানদারদের, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের। একেক পর্যায়ের মানুষের সচেতনতা দরকার একের কারণে। এই সচেতনতা গড়তে সবচেয়ে বড় ভূমিকা গণমাধ্যমের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবাণু মারতে বা ধ্বংস করতে নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়। রোগী যদি তা না করে, তাহলে ওই জীবাণু ওই অ্যান্টিবায়োটিকে মরে না, জীবাণু ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। অ্যান্টিবায়োটিক তখন অকার্যকর হয়ে পড়ে।
যৌথ গবেষণা
আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এবং ২০২১ সালের জুন-জুলাই মাসে ১০টি হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীদের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সেগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করেছে। হাসপাতালগুলোর মধ্যে আছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতাল।
গবেষকেরা ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে ৭ হাজার ৪৮৫ জন এবং ২০২১ সালের জুন-জুলাই মাসে ৭ হাজার ৬৫৮ জন রোগীকে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক পর্যালোচনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এই তালিকায় আছে সেফট্রিয়াক্সোন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, ফ্লুক্লোক্সাসিলিন, মেরোপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামোক্সোসিলিন + ক্যালভুলানিক অ্যাসিড, সেফুরোক্সিম, মোস্কিফ্লোক্সাসিন ও মেট্রোনিডাজোল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যান্টিবায়োটিকটি ৩৬ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ঠিকমতো কাজ করে কি না, তা-ও পরীক্ষা করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা দেখেছেন, সরকারি হাসপাতালে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সেফট্রিয়াক্সোন কাজ করে না। বেসরকারি হাসপাতালে তা ৪৩ শতাংশ। এভাবে প্রায় প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের কমবেশি অকার্যকর হওয়ার প্রমাণ গবেষকেরা পেয়েছেন।
পরামর্শ মানা হচ্ছে না
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওষুধটির পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। ২০১৯ সালে সংস্থাটি এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে। প্রথমে ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণি। এই শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা কম। এগুলো সাধারণত বেশি ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘ওয়াচ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যবহার করা যাবে, তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আর ‘রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে মরণাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে বা আইসিইউতে।
আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালগুলোতে ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়েছে ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে ‘ওয়াচ’ শ্রেণির ব্যবহার হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এই শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়েছে ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ‘রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।
আইইডিসিআরের অণুজীববিজ্ঞান শাখার প্রধান এবং এই গবেষণা দলের প্রধান জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকর হওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা আমরা দেখতে পেয়েছি। ব্যবহার করার মতো কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক যদি হাতে না থাকে, সবই যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে সমস্যা গভীরতর হবে।’
করণীয়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য ওষুধ প্রতিরোধবিষয়ক কার্যক্রম শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। এর সঙ্গে প্রাণী ও মৎস্যসম্পদ বিভাগের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, এই দুটি ক্ষেত্রেও অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয়। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, আইইডিসিআর, ওষুধ কোম্পানি, হাসপাতালের সঙ্গে কাজের সমন্বয় করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক অনিন্দ্য রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হবে, তার নির্দেশিকা আছে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ চলমান। হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ প্রতিরোধে কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কর্মসূচিও আছে।
অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ার বা জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই সমস্যাটি নিয়ে আলোচন হচ্ছে, গণমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে। তবে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো কর্মসূচি রোখে পড়ে না। এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অ্যান্টিবায়োটিক ঠিকমতো কাজ না করায় রোগীকে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে, রোগীকে হাসপাতালে বেশি দিন থাকতে হচ্ছে। রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।