দেশে লাল চোখের ব্যাঙ
নতুন একটি ব্যাঙের দেখা পাওয়া গেছে। ব্যাঙটি আগেও ছিল। কিন্তু ছিল ভিন্ন পরিচয়ে ও নামে। দুজন বন্য প্রাণী গবেষক আবিষ্কার করলেন এই ব্যাঙের আসল পরিচয়। তাঁরা ব্যাঙটির বাংলা, ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেছেন। আন্তর্জাতিক একটি গবেষণাপত্রেও স্থান পেয়েছে ব্যাঙটি আবিষ্কারের কাহিনি, তথ্য-উপাত্ত। বিশ্বের ব্যাঙ-তালিকায় নতুন প্রজাতির আরেকটি ব্যাঙ যুক্ত হলো।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পাওয়া গেছে ব্যাঙটি। আর একে খুঁজে পেয়েছেন বন্য প্রাণী গবেষক হাসান আল-রাজী ও মার্জান মারিয়া। তাঁদের গবেষণার কাজটি রাশিয়া থেকে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং সার্বিক সহযোগিতা করেছেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিক পয়ারকভ। গবেষকেরা এই ব্যাঙের নাম দিয়েছেন ‘সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ’। ইংরেজি নাম ‘সিলেটি লিটার ফ্রগ’ (Sylheti Litter Frog)। গত ২৮ মে এই ব্যাঙ নিয়ে তাঁদের গবেষণাপত্রটি যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব নেচার হিস্ট্রি’তে ছাপা হয়েছে।
গবেষক দলের সদস্য হাসান আল-রাজী জানালেন, এত দিন ব্যাঙটিকে লেপটোব্রাচিয়াম স্মিথি (Leptobrachium smithi) প্রজাতির মনে করা হতো। কিন্তু তাঁরা মনে করেন, এই প্রজাতির ব্যাঙের বিস্তৃতি বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে, ইন্দোনেশিয়া ও আশপাশে। পাখি হলে আসতে পারে। কিন্তু ব্যাঙ তো এত দূর আসতে পারে না। এসব কিছু চিন্তা করে তাঁদের মনে হয়েছে, বাংলাদেশে যে লেপটোব্রাচিয়াম প্রজাতিটি আছে, সেটা লেপটোব্রাচিয়াম স্মিথি হতে পারে না। এসব চিন্তাভাবনার মাঝে তাঁদের সঙ্গে রুশ অধ্যাপক নিক পয়ারকভের যোগাযোগ হয়। তিনিও এই ব্যাঙ নিয়ে একই কথা ভাবছিলেন বলে তাঁদের বলেন।
এরপর তাঁরা তিনজন মিলে একটা গবেষণা পরিকল্পনা করেন। এরপরই গত বছরের (২০২০) জুন মাসে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে এই দুই গবেষক লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে এক সপ্তাহ কাজ করেন। মাঠ থেকে ফিরে ব্যাঙ নিয়ে গবেষণার অন্য ধাপ শুরু করেন। প্রথমেই ব্যাঙটির শারীরিক মাপ নেন। তারপর বাকি কাজটুকু করেন গবেষণাগারে। পুরো কাজ রাশিয়া থেকে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতা করেছেন নিক পয়ারকভ। নতুন প্রজাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁরা এই ব্যাঙের শারীরিক পরিমাপ, এদের মলিকুলার বিশ্লেষণের পাশাপাশি এদের ডাকের বিশ্লেষণও করেন। তখনই তাঁদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এই প্রজাতির ব্যাঙ অন্য ব্যাঙের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
নতুন এই ব্যাঙের শরীরের রং ধূসর থেকে কালচে, শরীরে রয়েছে কালো ছোপ। এই রং তাদের ঝরাপাতার সঙ্গে মিশে থাকতে সাহায্য করে। এদের পেছনের পা তুলনামূলকভাবে ছোট। তাই খুব বেশি জোরে লাফাতে পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের চোখের ওপরের দিকের অর্ধেক লাল রঙের। যেখানে আলো পড়লে উজ্জ্বল প্রতিফলনের সৃষ্টি হয়।
গবেষক দলের সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রজাতির এই ব্যাঙ আবিষ্কারের আগে বাংলাদেশে মোট ৫৩ প্রজাতির ব্যাঙ ছিল। এটি আবিষ্কারের ফলে এখন ৫৪টি হয়েছে। বিশ্বেও আরেকটি নতুন ব্যাঙ যুক্ত হয়েছে।
গবেষক দলের অপর সদস্য মার্জান মারিয়া জানিয়েছেন, এই ব্যাঙগুলো মূলত বনের ভেতর ঝরাপাতার মাঝে মিশে থাকে। তবে প্রজননের সময় এরা ঝরাপাতা ছেড়ে ছড়ায় নেমে আসে। ছড়ার প্রবহমান স্বচ্ছ পানিতে ডিম দেয়। ডিম ফুটে ব্যাঙাচিগুলো ছড়ার পানিতে বড় হয়। ঝরাপাতায় থাকে বলে এই ব্যাঙকে ইংরেজিতে ‘লিটার ফ্রগ’ বলে।
গবেষক হাসান আল-রাজী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের জন্য এই ব্যাঙ প্রথম আবিষ্কার। যদিও আগেও এটি ছিল। কিন্তু ভিন্ন প্রজাতির পরিচয়ে। সব ব্যাঙের ডাক কাছাকাছি মনে হলেও এটির ডাক অন্য প্রজাতির ব্যাঙ থেকে আলাদা। ডাক অনেকটা হাঁসের মতো। নতুন প্রজাতি পেলে তার একটি বায়োলজিক্যাল নাম দিতে হয়। সিলেট অঞ্চলের হওয়ায় তার বৈজ্ঞানিকসহ সব নামকরণ সেভাবে করা হয়েছে।
এই গবেষক জানিয়েছেন, ব্যাঙটি আবিষ্কার করতে পেরে তাঁরা আনন্দ পেয়েছেন। একই সঙ্গে কষ্টও আছে। কারণ, এই ব্যাঙ হুমকিতে আছে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বন তার রূপ হারাচ্ছে। এটিসহ এখন পর্যন্ত লাউয়াছড়া বন থেকে বিশ্বের জন্য দুটি নতুন ব্যাঙ আবিষ্কার করা হয়েছে এবং আরও পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বনের যে ছড়াগুলোতে এই ব্যাঙসহ অন্য ব্যাঙ প্রজনন করে, সেই ছড়াগুলোর বেশির ভাগই শুকিয়ে গেছে। এমনটা হতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ‘সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ’টিকেও আর লাউয়াছড়া বনে না-ও পাওয়া যেতে পারে। এই ব্যাঙগুলো সংরক্ষণে বনের ছড়াগুলোকে বাঁচাতে হবে।