দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়ার অন্যতম নৌপথ শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি। এই পথে লঞ্চে পদ্মা পারাপারে ঘণ্টাখানেক লাগে। স্পিডবোটে আরও কম। আর ফেরিতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। ফেরিঘাটের দুর্ভোগ তো আছেই। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে নদী পার হতে লাগছে মাত্র ছয়-সাত মিনিট। এতে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট অনেকটাই অলস বসে আছে।
পদ্মা সেতু চালুর পর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথেও যাত্রী ও যানবাহন পারাপার কিছুটা কমেছে। পদ্মা সেতুর প্রভাব বিমানপথেও পড়তে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিয়মিত বিমানে যাতায়াতকারী অনেকেই বলছেন, তাঁরা সড়কপথে যাতায়াতে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সারা দেশে ৭০০-এর বেশি ছোট-বড় লঞ্চ চলাচল করে। এর মধ্যে সদরঘাট থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় চলাচল করে ১৫০-২০০ লঞ্চ। স্বাভাবিক সময়ে দিনে ১৫ হাজারের মতো যাত্রী চলাচল করে। ঈদে যাতায়াত বেড়ে লাখে ঠেকে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ অধিকাংশ জেলায় বাসে যাওয়া যাচ্ছে তিন-চার ঘণ্টায়। আর লঞ্চে লাগে সারা রাত। ফলে যাত্রী কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
লঞ্চমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সহসভাপতি সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর প্রভাব পড়বে। তবে ব্যবসা বন্ধ হবে না। কারণ, লঞ্চযাত্রা নিরাপদ, সাশ্রয়ী, আরামদায়ক। একা যাত্রায় হয়তো অনেকে বাসে যাবে। পরিবারসহ গেলে লঞ্চ বেছে নেবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু চালুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প-বাণিজ্য ও ব্যবসা বাড়বে। ফলে লঞ্চে যাতায়াত আবারও বাড়বে।
ফেরির বিকল্প পথ খুঁজছে বিআইডব্লিউটিসি
সরকারের নৌপরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির বহরে বিভিন্ন শ্রেণির ৪৭টি ফেরি রয়েছে। এসব ফেরি দেশের ছয়টি নৌপথে চলাচল করে। এর মধ্যে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি পথেই সবচেয়ে বেশি ফেরি চলাচল করে। এই দুটি পথ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম ভরসা। পদ্মা সেতু চালুর পর শিমুলিয়া-বাংলাবাজার পথে ফেরি পারাপার বন্ধ রয়েছে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি নৌপথে ৮টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও প্রায় ২০০ স্পিডবোট অনেকটা অলস বসে আছে। ১৯৮৭ সাল থেকে এই পথে ফেরি চালু হয়েছিল।
বিআইডব্লিউটিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ফেরিগুলো স্ট্যান্ড বাই রাখতে বলা হয়েছে। আগামী পবিত্র ঈদুল আজহার পর ফেরি রাখা না রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
এরই মধ্যে ফেরির জন্য বিকল্প পথ খুঁজে বের করেছে বিআইডব্লিউটিসি। পথগুলোর মধ্যে রয়েছে কুড়িগ্রামের রৌমারী-চিলমারী, জামালপুরের বাহাদুরাবাদ-বগুড়ার সারিয়াকান্দি, জামালপুরের মাদারগঞ্জ-বগুড়ার সারিয়াকান্দি, রাজবাড়ীর জৌকরা-পাবনার নাজিরগঞ্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া হয়ে ভোলার মনপুরা ও তজুমদ্দিন, ভোলার লালমোহনের নাজিরপুর-কালাইয়া, বরগুনার বগীবাজার-চালিতাতলী এবং চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ।
বিআইডব্লিউটিসির হিসাবে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি পথে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাড়ে আট লাখের মতো যানবাহন পারাপার করেছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ২ হাজার ৩০০-এর বেশি যানবাহন পারাপার করেছে।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পথে সবচেয়ে বেশি, ২১টি ফেরি চলাচল করে। দিনে গড়ে দুই দিক থেকে ছয় হাজার যানবাহন পারাপার হয়। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি, ঈদের সময় যানবাহন আরও অনেক বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু চালুর পর দিনে শ পাঁচেক যানবাহন পারাপার কমেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
লঞ্চ-স্পিডবোটের দুর্দিন
শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি নৌপথে ৮৭টি লঞ্চ চলাচল করত। সব লঞ্চ দিনে অন্তত তিনটি যাত্রার সুযোগ পেত। গড়ে হাজারখানেক যাত্রী পারাপার করত প্রতিটি লঞ্চ। পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চে আর যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার সারা দিনে শিমুলিয়া থেকে তিনটি এবং ওপার থেকে দুটি লঞ্চ চলেছে। এতেও ৫০-৬০ জন করে যাত্রী পাওয়া গেছে। যার বেশির ভাগ শরীয়তপুরের এবং নদীপাড়ের মানুষজন। এত কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালিয়ে জ্বালানি খরচ উঠবে না বলে মনে করছেন লঞ্চমালিকেরা।
শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি নৌপথের লঞ্চমালিকদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ব্যবসার আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ইতিমধ্যে কেউ কেউ লঞ্চ বিক্রি করে দিয়েছেন। অন্য জেলায় গিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।
ভাড়া নৈরাজ্য, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও হয়রানির পরও স্পিডবোটে প্রচুর মানুষ যাতায়াত করত। এখন সেগুলো ঘাটে ঠায় বসে আছে। স্পিডবোট ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিকান্দি পথে নিবন্ধিত স্পিডবোট আছে দেড় শর মতো। এর বাইরে অনিবন্ধিত আরও ৫০টির মতো চলাচল করত। দিনে প্রায় আট হাজার মানুষ যাতায়াত করত। পদ্মা সেতু চালুর পর তিন-চারটি বোট বিক্রি হয়েছে, বাকিগুলো বিক্রির অপেক্ষায়।
স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার সালাউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বরিশাল-ভোলা, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীসহ দক্ষিণের কয়েকটি স্থানে কিছু স্পিডবোট হয়তো চলবে। তাই বোট বিক্রি করা ছাড়া বিকল্প নেই।
বিমান যাতায়াতেও প্রভাব
ঢাকা-বরিশাল আকাশপথে সপ্তাহে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের আটটি ফ্লাইট পরিচালিত হয়। যাত্রা ৩০ মিনিট বা তারও কম সময়ের। কিন্তু বিমানবন্দরে যাওয়া এবং নেমে বিমানবন্দর থেকে শহরে যাতায়াত—এর পেছনে সাড়ে চার ঘণ্টা চলে যায়। বাসে এখন লাগছে তিন থেকে চার ঘণ্টা।
এই পথে নিয়মিত বিমানে যাতায়াত করেন ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি পরিবারসহ বিমানে যাতায়াতে ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। হিসাব করে দেখেছেন, পদ্মা সেতু হয়ে যাতায়াত করলে খরচ কম হবে। সময় একই বা কমও লাগতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, নিজের গাড়িতে যাতায়াতে স্বাধীনতা পাবেন। বরিশালের মতো না হলেও যশোরের আকাশপথেও কিছু প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে যাঁদের যশোরে বিমানে গিয়ে পরে সড়কপথে খুলনা কিংবা সাতক্ষীরাসহ অন্য জেলায় যেতে হয়, তাঁরা হয়তো সড়কপথই বেছে নেবেন।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে বিভিন্ন স্থানে ফেরি দরকার। আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, সেগুলো লাভজনক ও জনগণের জন্য উপকারী হবে। ফলে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটের ফেরি বন্ধ হলেও সমস্যা হবে না।’ তিনি আরও বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এখন পদ্মা সেতুর সুফল পাচ্ছে। কারণ, এত দিন যে অস্বাভাবিক চাপ ছিল, তা আর নেই। ঢাকা থেকে দক্ষিণের পথে লঞ্চ চলাচলে যাত্রী কমবে না বলে তিনি মনে করেন।