‘থানা-পুলিশ করলে খুন করে লাশ পুঁতে ফেলা হবে’
ঢাকার নবাবগঞ্জের তরুণ সাইদুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন ইউরোপের দেশ ইতালিতে গিয়ে নিজের ভাগ্য ফেরাবেন। সেই স্বপ্নপূরণে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নরসিংদীর নুরুল আলম সুমনের সহযোগী তুহিনুজ্জামানকে ছয় লাখ টাকা দেন তিনি।
২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে করে সাইদুরকে নেওয়া হয় থাইল্যান্ডে। পরদিন থাইল্যান্ড থেকে উড়োজাহাজে করে তাঁকে নেওয়া হয় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ টোগোতে। টোগোর বিমানবন্দর থেকে তাঁকে একটি হোটেলে নিয়ে যান নুরুল। পরে তাঁকে নিয়ে যান ইদুর বাসায়। সেখানকার একটি বাসায় তাঁকে আটকে রেখে পরিবারের কাছে মুক্তিপণের জন্য টাকা চাওয়া হয়। সাইদুরের পরিবারের কাছ থেকে আরও সাত লাখ টাকা নেন তুহিনুজ্জামান। কিন্তু তাঁকে মুক্তি না দিয়ে টানা ১৫ মাস ইদুর বাসায় আটকে রেখে নির্যাতন করেন নুরুল ও ইদুর লোকজন। একপর্যায়ে সেখান থেকে তিনিসহ চারজন পালান। দেশের একটি মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) সহযোগিতায় চার মাস আগে টোগো থেকে দেশে ফিরে আসেন তাঁরা। দেশে ফিরে নুরুলদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলা করেন সাইদুর।
প্রাণ নিয়ে দেশে ফেরার কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন সাইদুর। গত বুধবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভাত খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু টোগোতে যে বাসায় আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখানে দিনের পর দিন শিমের বিচি খেতে দেওয়া হতো। খেতে ইচ্ছা না করলেও বেঁচে থাকার জন্য খেতে হতো। কল্পনাও করিনি যে ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমাকে আফ্রিকার দেশ টোগোতে নিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখা হবে। নির্যাতন করা হবে। নুরুল আমায় হুমকি দিয়ে বলতেন, থানা-পুলিশ করলে খুন করে লাশ পুঁতে ফেলা হবে।’
সাইদুর জানান, ইদু টোগোর মানব পাচারকারী চক্রের হোতা। তাঁর ভাড়া করা বাসায় তিনিসহ ৩০–৪০ জনকে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রথম দিকে নুরুল ভালো ব্যবহার করছিলেন। পরে নুরুলের কাছে তিনি জানতে চান, কবে তাঁকে ইতালিতে পাঠানো হবে। জবাবে নুরুল বলেছিলেন, শিগগির পাঠানো হবে। তিন মাস পার হওয়ার পর একদিন ইদু তাঁদের কক্ষে আসেন। সেখানে আনোয়ার নামের এক বাংলাদেশি যুবককে ইদু লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান।
সাইদুর বলেন, ‘আনোয়ারকে যেদিন পেটানো হলো, সেদিনই আমি বুঝেছিলাম নুরুলের ফাঁদে আটকে গেছি। তখন কীভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায়, সেই চিন্তাই করতে থাকি। এক বছর বদ্ধ ঘরে আটকে থাকায় আমার শরীরে ঘা হয়ে যায়। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। গত বছরের জানুয়ারিতে আমার হাতে একটি মুঠোফোন আসে। তখন একটি অনলাইন গ্রুপে আমাদের অবস্থা জানিয়ে দিই। তারপর আওয়াজ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গত ৩০ মার্চ আমিসহ চারজন টোগোর ওই বাসা থেকে পালাতে সক্ষম হই। পরে আইএমওর সহযোগিতায় গত ২ এপ্রিল উড়োজাহাজে করে দেশে ফিরে আসি।’
আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আনিসুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টোগোর একটি বাসায় সাইদুরদের আটকে থাকার কথা জানার পর তাঁরা আইএমওর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় সাইদুর, আল-আমিন, আবুল হাসান ও ইয়াসিনকে তাঁরা দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। কিন্তু এখনো টোগোর একটি বাসায় আরও ৩০–৩৫ জন বাংলাদেশি আটকে আছেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তাঁদের উদ্ধার করার চেষ্টা তাঁরা করছেন।
সাইদুরের সঙ্গে টোগো থেকে দেশে ফিরেছেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার যুবক আল-আমিন। বুধবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আব্বা ভাঙারি ব্যবসা করেন। অভাবের মধ্যেই ২০১৮ সালে আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। স্বপ্ন দেখেছিলাম, ইউরোপের দেশ জার্মানিতে গিয়ে কাজ করব। তবে আমার সেই স্বপ্ন চরম দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। জমি বিক্রির ১৬ লাখ টাকা আমি নুরুলের কাছে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু নুরুল আমার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন। টোগোতে নিয়ে দিনের পর দিন নুরুল ও ইদু আমাকে নির্যাতন করেছেন।’
আল-আমিন জানান, একটা বদ্ধ ঘরে দিনের পর দিন আটক থাকার পর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। আটক অবস্থায় তিনবেলার জায়গায় দুবেলা খাবার দেওয়া হতো। প্রতিদিন খাবারের তালিকায় থাকত শিমের বিচি। এ ছাড়া চলত নির্যাতন। মারধরের সময় প্রায়ই বলা হতো যেকোনো দিন জানে মেরে ফেলা হবে।
ইউরোপে নেওয়ার কথা বলে আফ্রিকার দেশে টোগোতে নিয়ে নির্যাতন করে টাকা আদায়ের অভিযোগে সম্প্রতি নুরুলসহ ১০–১৫ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মানব পাচারের মামলা করেন সাইদুর। এই মামলায় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ইতিমধ্যে নুরুলের স্ত্রী মাহামুদা রশীদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। চারজনই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে। আর নুরুল পলাতক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) সাগর আহম্মেদ বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল ও তাঁর সহযোগীরা ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইতিমধ্যে ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি যুবককে আফ্রিকার দেশ টোগোতে নিয়ে গেছেন। সেখানে বছরের পর বছর এই লোকগুলোকে আটকে রেখে নির্যাতন করে টাকা আদায় করা হচ্ছে। নুরুলের স্ত্রী মাহামুদাও এই চক্রের সদস্য। নুরুল-মাহামুদা দম্পতির ব্যাংক হিসাবে অনেক টাকা রয়েছে বলে জানা গেছে। নুরুলের চেক বই জব্দ করা হয়েছে। এই দুজনসহ অন্যদের ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে জানতে আদালতের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে।