তাঁর কাছ থেকে আদালতও ভালো আচরণ পাননি
রায় ঘোষণার সময় গতকাল মঙ্গলবার আসামির কাঠগড়া থেকে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী কখনো পুলিশ, কখনো তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হাসি-তামাশা করেছেন। আবার কখনো তাঁকে দেখা গেছে মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে স্বগতোক্তি করতে। বরাবরের মতোই তিনি বিচারকদের ব্যঙ্গও করেছেন।
সকালে ট্রাইব্যুনালে আনার সময় সাকা চৌধুরী গণমাধ্যম ও নিরাপত্তাকর্মীদের উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নাড়েন। তাঁকে কাঠগড়ায় তোলার পর পুলিশের সদস্যরা পাশে সার বেঁধে দাঁড়ান। সেখানে দাঁড়িয়ে সাকা চৌধুরীর নানা আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন এই প্রতিবেদক।
রায় ঘোষণার শুরুতে বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাকা চৌধুরীকে পাঁচবার নির্বাচিত সাংসদ বলে উল্লেখ করলে তিনি ও কাঠগড়ার সামনে রাখা আসনে বসা তাঁর স্ত্রী বলে ওঠেন, ‘সিক্স টাইমস, সিক্স টাইমস (ছয়বার)।’ এরপর সাকা চৌধুরী বলেন, ‘কয়বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছি তাও বলতে পারে না।...এত মিথ্যা কথা বলছে, ওটা লিখতে ভুলে গেছে।’
রায়ের প্রথম অংশ পড়ার একপর্যায়ে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ রায় দিয়ে নির্বাচিত করেছে, আর আমি এই তিনজনের রায় শুনতে এসেছি...।’ তিনি বিচারকদের সম্পর্কে নানা কটূক্তি করেন।
সাকা চৌধুরীর স্ত্রীকে কয়েকবার বলতে শোনা যায় যে এ রায় অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। সাকা চৌধুরীও তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এ রায় অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে, এখানে পড়ার কী দরকার স্যার?’
নূতনচন্দ্রকে হত্যার অভিযোগের বর্ণনার সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, তিনি একজন জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাকা চৌধুরীর কাছ থেকে মন্তব্য আসে, ‘সে মদ বেচত।’
ট্রাইব্যুনাল তৃতীয় অভিযোগের রায় পড়ার সময় সাকা চৌধুরী বলেন, ‘যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক মারা গেছে তো? লেইখা দিলেই হয়, তার মধ্যে ২০ লাখ আমি মারছি...।’
তবে কাঠগড়া থেকে অন্তত ৩০ ফুট দূরে এজলাসে বসা বিচারকদের পক্ষে সাকা চৌধুরীর এসব বক্রোক্তি শোনা সম্ভব ছিল না। জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনালে বিচারক মাইক্রোফোনে রায় পড়ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল ঘটনাস্থলে পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে সাকা চৌধুরীর উপস্থিতির কথা যখন পড়ছিলেন তখন তিনি বলেন, ‘অভিযোগে যেসব এলাকায় যাওয়ার কথা বলছে, নির্বাচনে ভোট চাওয়ার জন্যও সেসব এলাকায় যাইনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এত সাহায্য দরকার হয়েছে যে প্রতিটি জায়গায় আমাকে যেতে হয়েছে?’
এক প্রসঙ্গে বরিশালের ভাষায় সাকা চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘শালারা ছাগল তো ছাগলই।’ তখন পুলিশের এক সদস্য তাঁকে বলেন, ‘স্যার, এটা তো বরিশালের ভাষা!’ ‘আমার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী বরিশালের বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন।’ বলেই হাসতে থাকেন সাকা চৌধুরী।
বিচারকদের কটাক্ষ করে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘কী ইংরেজি লিখছে? নিজেরাই পড়তে পাড়ছে না।’ রায়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রসঙ্গ এলে টিপ্পনী কাটেন, ‘সহি হাদিস’।
রায়ের চূড়ান্ত অংশে ট্রাইব্যুনাল তাঁর পর্যবেক্ষণে আদালতের প্রতি সাকা চৌধুরীর বরাবরের অবজ্ঞাসূচক আচরণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, বিচারকেরা এজলাস ছাড়ার সময়েও তিনি উঠে দাঁড়াতেন না। সাকা চৌধুরী তখন বলতে থাকেন, ‘নো, নেভার।’
রায়ে পর্যবেক্ষণ: রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ২০১২ সালের ১৪ মে আদালতকক্ষের শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং চিৎকার করে কথা বলার জন্য সাকা চৌধুরীকে সতর্ক করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর ওই দিনে সাকা চৌধুরী চিৎকার করে কথা বললে ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ‘মিস্টার চৌধুরী, উইল ইউ কিপ কোয়ায়েট?’ (জনাব চৌধুরী, আপনি কি শান্ত থাকবেন?)
ওই দিন সাকা চৌধুরী উচ্চ স্বরে বলেছিলেন, ‘মিস্টার নিজামুল হক, ডোন্ট শো ইউর রেড আইজ, আই রিকোয়েস্ট ইউ উইথ ডিউ রেসপেক্ট অ্যান্ড হিউমিলিটি।’ (জনাব নিজামুল হক, চোখ রাঙাবেন না, যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে বলছি।)
গতকালের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সরকার তাঁদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, কিন্তু সাকা চৌধুরী তাঁদের কখনো কখনো ‘চেয়ারম্যান সাহেব’ বা ‘মেম্বার সাহেব’ বলে ডাকতেন।
এই সময় সাকা চৌধুরীকে বলতে শোনা যায়, ‘সে তো আমাকে মাননীয় সাংসদ বলে নাই, আমি কেন সুপ্রিম কোর্টের জজ হিসেবে সমর্থন করে তাঁকে মাই লর্ড বলতে যাব?’
ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, আসামি একজন আইনপ্রণেতা। কিন্তু তাঁর আচরণে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাই প্রকাশ পেয়েছে বারবার। তিনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কিন্তু আদালতকক্ষে তাঁর আচরণ ভালো ব্যবহারের পরিচয় দেয় না। একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে আসামি সাকা চৌধুরীকে মনে রাখতে হবে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামির ব্যব্যহারের কোনো প্রভাব এ রায়ে পড়েনি।
সাজা ঘোষণার আগে-পরে: সাজা ঘোষণা শুরু হলে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘তাড়াতাড়ি ফাঁসি দিয়ে দাও। সাঈদীর মতো লোকরে ফাঁসি দিছে, আমি তো মস্ত বড় গোনাগার।’
রায় পড়া শেষে সাকা চৌধুরী উচ্চ স্বরে বলতে থাকেন, ‘এ রায় তো আগেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়েছে। এ জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ।...রায় এসেছে বেলজিয়াম থেকে। এরা শুধু মুখ নাড়ছে।’
সাকার আচরণের আমলনামা: ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে প্রথম হাজিরার দিন থেকেই বিচারকদের সঙ্গে তর্ক শুরু করেন সাকা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি সিটিং মেম্বার অব পার্লামেন্ট। আমাকে কথা বলতে দিতে হবে। বর্তমান সরকার কারজাই সরকার। এই কারজাই সরকারকে মানি না।’
ট্রাইব্যুনালে বিএনপির সমর্থক ও আইনজীবীদের ঢোকা নিয়ে হইচই হলে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে ৫০০ কেন, ৫০০০ আইনজীবী আসবে। প্রয়োজনে কারওয়ান বাজার, পল্টন ময়দানে বিচার হবে। আমি সংসদ ভবনেও ক্যাঙ্গারু কোর্ট দেখেছি।’
২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি শুনানির দ্বিতীয় দিনে এজলাসে ঢুকেই সাকা চৌধুরী বলেন, ‘এটা কি ক্যামেরা ট্রায়াল? পাবলিক ট্রায়াল হতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যদি পাবলিক ট্রায়াল হয়, আমারটা কেন পাবলিক ট্রায়াল হবে না?’
ওই দিন সাকা চৌধুরী ঘোষণা দেন, নিজেই নিজের পক্ষে লড়বেন—‘আমি থাকতে আমার আইনজীবী লাগবে কেন?’
সে বছরের ২০ এপ্রিল কারাভ্যান থেকে সাকা চৌধুরীকে পুলিশের ছয়-সাতজন সদস্য কোলে করে এজলাসে আনেন। তিনি কাঠগড়ায় রাখা চেয়ারের সারির ওপর শুয়ে পড়েন। পরে তাঁকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চায় প্রসিকিউশন। এ সময় তিনি বলেন, ‘গণ-আদালতে একবার এ অপরাধে বিচার হয়েছে। এক খাসি কতবার কোরবানি দেবেন?’
পরে শুনানি শেষে সাকা চৌধুরীকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আদেশে বলা হয়, আদালতে আনার সময় সাকা চৌধুরী নিজেকে অসুস্থ বলে দেখিয়েছেন। কিন্তু আদালতে তিনি এত জোর গলায় কথা বলেছেন যে মনে হয়েছে, তিনি অসুস্থতার ভান করছেন।
২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে কোনো অভিযোগ ছাড়া গ্রেপ্তার করে তারপর তদন্ত করা হলো। ব্যাপারটা এমন—বাপের পরিচয় ছাড়া ছেলের শাদি হয়ে গেছে। এখন বাপের পরিচয় হালাল করতে বাপের বিয়ে করাচ্ছে।’
এরপর ২৯ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় ট্রাইব্যুনাল তাঁর আইনজীবীদের খোঁজ জানতে চান। তিনি বলেন, তাঁরা ট্রাইব্যুনালের ভয়ে আসছেন না। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে সতর্ক করে বলেন, ‘এটা মজা করার জায়গা নয়।’
পরদিন সাকা চৌধুরী দাবি করেন, শুধু তাঁকে শাস্তি দিতে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল আইনের তুলনা করে তিনি বলেন, এখন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা হয়ে গেছে।
ওই দিন আত্মপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার সময় সাকা চৌধুরী ‘সেনাবাহিনী’ শব্দটি দুবার ‘সোনাবাহিনী’ উচ্চারণ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ আল-মালুম এর প্রতিবাদ করে বলেন, সাকা চৌধুরী ইচ্ছা করে সেনাবাহিনীকে কটাক্ষ করেছেন।
ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করেন, এমন শব্দ বলেছেন কি না? সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।