ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজ

পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী এলাকায় অবস্থিত ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনালয় l ছবি: মনিরুল আলম
পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী এলাকায় অবস্থিত ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনালয় l ছবি: মনিরুল আলম

গেট পেরোলেই লোহার রেলিংঘেরা বাগান। সেখানে রয়েছে হরেক রকমের গাছ। ফুলের দেখা কম পেলেও সবুজের কমতি নেই। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে সাদা ও লাল রঙের মিশেলে দোতলাসমান উঁচু একতলা ভবনটি। সেটির চূড়ায় নকশাদার ফলকে সাদা রঙে লেখা—ব্রাহ্ম সমাজ।
বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরটি পাটুয়াটুলীতে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ঠিক পাশেই। মন্দিরের কাছে যেতেই একজন নারী এগিয়ে এলেন। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললেন, কবিতা রানী দত্ত রায়। সাপ্তাহিক প্রার্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তাঁর স্বামী একজন ব্রাহ্ম। বিয়ের পর কবিতা এ সমাজেরই একটি অংশ হয়ে গেছেন। ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাইলে বললেন, ‘অনেকে মনে করে আমরা বুঝি ব্রাহ্মণ। কিন্তু শব্দটা ব্রাহ্ম। আর হিন্দু ধর্মের একটি বর্ণ হলো ব্রাহ্মণ। আসলে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য তো মুষ্টিমেয় কয়েকজন। তাই এটি অনেকে বুঝতে পারে না।’
বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, বেদান্তের একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ গঠন করেন। পরে এটি ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্মরা নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করেন। এই সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করা। এর সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম জড়িয়ে আছে।
পাটুয়াটুলীতে ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে প্রতি রোববার প্রার্থনা হয়। সমাজের সাধারণ সম্পাদক রনবীর পাল বললেন ব্রাহ্ম সমাজের আদ্যোপান্ত। ব্রাহ্মদের মধ্যে দুটি ভাগ আছে। এ দুটি হলো জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম ও অ-আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম। হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা ব্রাহ্মধর্ম সমর্থন করেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি, তাঁরাই অ-আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম। তাঁরা সমাজের সদস্যও হতে পারেন। এ ছাড়া দীক্ষালাভের মাধ্যমেও ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়া যায়। বর্তমানে সারা দেশে মোট ব্রাহ্মের সংখ্যা ৬২। তবে জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম আছেন মাত্র ১৩ থেকে ১৫ জন। ব্রাহ্ম সমাজের কার্যনির্বাহী কমিটি সাত সদস্যের। এ ছাড়া সাত সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডও আছে। তাঁরা মন্দিরসহ সব সম্পদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন।
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজের এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা সমগ্র বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, মন্দির প্রতিষ্ঠায় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক দীননাথ সেন প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময় ভবনটি নির্মাণে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। তখন বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ পরিচিত ছিল ‘ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে। কিছুদিন আগেই শত বছরের পুরোনো ভবনটির সংস্কারের কাজ হয়েছে। আগে অনেক জায়গা ভাঙাচোরা ছিল। এখন তা সারানো হয়েছে।
মন্দিরের আচার্যের দায়িত্বে আছেন দীপক পাল। তিনি প্রার্থনাসভা পরিচালনা করেন। তিনি বললেন, ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষ আসতে পারে। বিশেষ কিছু দিনে মন্দিরে উৎসব হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে বাংলা সনের ১১ মাঘ বিশেষ কর্মসূচি থাকে। তখন এখানে বেদের সঙ্গে সঙ্গে কোরআন, ত্রিপিটক, বাইবেলও পাঠ করা হয়। এ ছাড়া পয়লা বৈশাখ রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করেন ব্রাহ্মরা।
এখন অবশ্য ব্রাহ্ম সমাজের সেই রমরমা অবস্থা নেই। এর সদস্য দিনে দিনে কমছেই। নেহাত পালা-পার্বণেই কিছুটা লোকসমাগম হয়। সাপ্তাহিক প্রার্থনায় যেমন পাওয়া গেল হাতে গোনা কয়েকজনকে। দীপক পাল বললেন, নতুন করে আর কেউ এই সমাজের সদস্য হচ্ছেন না। প্রচারণার কাজও এখন বন্ধ।

>বেদান্তের একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ গঠন করেন। পরে এটি ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্মরা নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করেন। এই সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করা

ব্রাহ্ম সমাজ জনহিতকর কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। রনবীর পাল বললেন, এখন খুবই স্বল্প পরিসরে এ ধরনের কাজ হচ্ছে। শীতকালে গরিব মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ করে থাকেন তাঁরা। কখনো সহায়সম্বলহীন অসুস্থ ব্যক্তিদের ওষুধ কিনে দেওয়া হয়।
মন্দিরে যাওয়ার সরু পথের ডান পাশে রয়েছে পুরোনো দুটি বাড়ি। একটিতে ঝোলানো রয়েছে নোটিশ বোর্ড। তাতে লেখা, ‘ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার আপাতত বন্ধ থাকিবে।’ এর নিচেই সিমেন্টের আস্তর ভেঙে বেরিয়ে এসেছে লাল ইটগুলো। দোতলা বাড়িটির সদর দরজা ছাড়া বাকি দরজা-জানালাও ভাঙাচোরা। মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বই থেকে জানা যায়, ১৯১০ সালে লাইব্রেরির জন্য ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল।
ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য অরিন্দম চক্রবর্তী বলেন, রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি মূল উপাসনা ভবনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আগের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তাই ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি এই লাইব্রেরি পুনরায় উদ্বোধন করা হয়।
উপাসনালয়ের পেছন দিক দিয়ে লাইব্রেরিতে যেতে হয়। চেয়ার-টেবিলে থাকা ধুলার পুরু আস্তরণ বুঝিয়ে দেয়, অনেক দিন পাঠকের দেখা নেই। বইগুলোতেও বেশ ধুলা জমেছে। ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ লাইব্রেরিতে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই ও পুঁথির এক বিশাল সংগ্রহ ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে দেয়। সেই সময়ই এর মূল সংগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান অরিন্দম চক্রবর্তী।
ব্রাহ্ম সমাজের এই মন্দিরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। রনবীর পাল বলেন, ১৯২৬ সালে তিনি এখানে প্রার্থনা করেছিলেন। মন্দিরের প্রার্থনার ঘরে একটি বেদি আছে। তার চারপাশে বেঞ্চের সারি। সেখানে বসেই ঈশ্বরের আরাধনা চলে। রবিঠাকুরের গানের ফাঁকে ফাঁকে আচার্য বৈদিক মন্ত্র পড়ে শোনান।
কথা বলতে বলতেই প্রার্থনা শেষ হয়ে এল। একে একে নিভিয়ে দেওয়া হলো মন্দিরের সব বাতি। কানে তখনো বাজছে প্রার্থনায় গাওয়া পূজা পর্বের সেই গান, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি। তোমায় দেখতে আমি পাইনি’।