বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন
মেধাবী ছাত্র ছিলেন ডা. এ বি এম হুমায়ুন কবীর। শিল্পী ও সমাজসেবক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। ভালো গিটার বাজাতে পারতেন, নাটকে অভিনয় করতেন। এ ছাড়া স্কাউটিং ও বিনা মূল্যে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবায় ছিল তাঁর উৎসাহ।
হুমায়ুন কবীর এমবিবিএস পাস করেছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ছিল তাঁর আনুগত্য। মওলানা ভাসানী ছিলেন তাঁর আদর্শ। ছাত্রজীবনে এক মেয়াদে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে এ দেশের বাঁচার আর কোনো বিকল্প নেই।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের বাড়িতে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আহত লোকজনের চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্যোগ নেন হুমায়ুন কবীর। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন ওষুধ নিতে। ঢাকায় এসে তিনি উঠতেন ছোট বোন শেলী আকবরের হাতিরপুলের বাসায়।
হুমায়ুন কবীর শেষবার ঢাকায় আসেন নভেম্বর মাসে। এসে বোনকে বলেছিলেন, ‘আর মনে হয় ঢাকায় আসা যাবে না। মনে হচ্ছে, কেউ আমার ওপর নজর রাখছে।’ তাঁর অনুমান মিথ্যা হয়নি। ১৫ নভেম্বর ভোর থেকেই ওই এলাকায় ছিল কারফিউ। রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদররা অবস্থান নিয়েছিল। এটা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁকে ধরার জন্যই হয়তো কারফিউ দেওয়া হয়েছে।
সেদিন সকালে হুমায়ুন কবীরের বোনের প্রতিবেশী ডা. আজহারুল হককে (তাঁর সঙ্গে শহীদ) নেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসার কথা ছিল। এটা জেনে ওই অ্যাম্বুলেন্সে চলে যাওয়া নিরাপদ ভেবে তিনি তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন। তাঁরা বাড়ির সামনে নিচে অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় আলবদররা তাঁকে ও ডা. আজহারুল হককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরদিন ১৬ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের কাছে কালভার্টের নিচে তাঁদের চোখ, হাত ও পা বাঁধা বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়।
হুমায়ুন কবীরের ছোট বোন শেলী আকবরের ‘আমার ভাই’ রচনা থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়। শেলী আকবর লিখেছেন, ‘নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ঢাকায় আসেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় কার্ফু দিয়ে তল্লাশী চালানো হতো। পনেরই নভেম্বর ভোর পাঁচটা থেকে কার্ফু দিয়ে হাতিরপুল এলাকা ঘেরাও করা হয়। ঘেরাও করে কুখ্যাত আলবদর আলশামস বাহিনী। মিয়াভাই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তল্লাশীতে তিনি ধরা পড়তে পারেন। তিনি বাসা থেকে পালিয়ে যাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। এ সময়ে আমাদের প্রতিবেশী ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী সার্জন ডাঃ আজহারুল হককে নেয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। সেই এ্যাম্বুলেন্সে মিয়াভাইও যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। পরে জানতে পারি, আলবদর নরপশুরা এ্যাম্বুলেন্স ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।
‘কার্ফু তুলে নেওয়ার পর মেডিকেল কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ডাঃ হক ও মিয়াভাই হাসপাতালে যাননি। আমার স্বামী দিশাহারা হয়ে তাঁর একজন সহকর্মীকে নিয়ে বিভিন্ন থানায় খোঁজখবর করতে থাকেন। পরদিন সকালে মিয়াভাই ও ডাঃ হকের বিকৃত লাশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। মর্গ থেকে লাশ নিয়ে কোনো রকমে জানাজা পড়ে রাতের কার্ফুর আগেই আজিমপুর গোরস্থানে তাঁদের সমাহিত করা হয়।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার শফিপুর থানাধীন চরভাগা বকাউলকান্দি গ্রামে ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি এ বি এম হুমায়ুন কবীরের জন্ম। বাবা নূরুল হক সরকার, মা বিলকিস বেগম। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। চাঁদপুর জেলার মতলব হাইস্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এমবিবিএস পাস করার পর ইন্টার্নশিপ শুরু করার আগেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
সূত্র: প্রকৌশলী ওয়াসেল কবীর (এ বি এম হুমায়ুন কবীরের ছোট ভাই)। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান