জীবনে একবারই মারামারি করেছিলেন কারাতে গুরু রতন
সবে কৈশোর পেরিয়েছেন রতন তালুকদার। নতুন নতুন মার্শাল আর্ট শিখছেন। একদিন পাড়ার এক বন্ধু কেঁদে-কেটে এসে বিচার দিল, তাকে অন্যায়ভাবে মেরেছে পাড়ারই আরেক বড় ভাই। দুর্বলের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে সেই বড় ভাইকে নানচাকুর এক বাড়িতেই কূপোকাত।
বেশ কয়েক ঘণ্টা জ্ঞান ছিল না বড় ভাইয়ের। এমন দশা যে হবে ভাবতে পারেননি রতন। ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু মার খাওয়া পাড়াতো ভাইটি সুস্থ হয়ে যাওয়ায় আর সে যাত্রায় ফেরার হতে হয়নি। জীবনে ওই একবারই মারামারি করেছেন। দীর্ঘ চার দশক মার্শাল আর্টের সঙ্গে আছেন। এরপর আর কারও গায়ে হাত তোলেননি। হাসিখুশি এই মানুষটি কারাতেকে নিছক খেলাধুলাই মনে করেন।
গত রোববার বিকেলে নগরের নন্দনকাননের ফুলকি বিদ্যালয়ে আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। প্রতি রবি ও মঙ্গলবার ওই বিদ্যালয়ে কারাতে শেখান তিনি। সেখানে ঢুকতেই দেখা গেল ছোট-বড় প্রায় জনা ত্রিশেক শিক্ষার্থী সাদা গাউন পরে অনুশীলন করছে।
বয়স ৫৮ বছর। সেটা না বলে দিলে বোঝার উপায় নেই। ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা চুল আর মুখের দু-একটা ভাঁজ ছাড়া আর কোথাও বয়সের ছাপ নেই। দীর্ঘদেহী, পেটানো শরীর। সবাই তাঁকে চেনে শিহান রতন নামে। শিহান জাপানি শব্দ, যার অর্থ মাস্টার। ব্ল্যাক বেল্ট সিক্স ডেন অর্জন করলেই কেবল এমন উপাধি মেলে। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ছিলেন বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সদস্য। বর্তমানে বাংলাদেশ কারাতে রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি। প্রতিষ্ঠা করেছেন কারাতে ক্লাব, হোনকে সোতাকান কারাতে দো অ্যাসোসিয়েশন। ফ্রেন্ডস ক্লাব কারাতে একাডেমির প্রধান প্রশিক্ষকও তিনি। তাঁর প্রশিক্ষণে ফ্রেন্ডস ক্লাব দল গত দুইবারসহ মোট তিনবার চট্টগ্রামে কারাতের শিরোপা জিতেছে। চট্টগ্রাম শহর, চন্দনাইশ উপজেলা, কক্সবাজার ও নোয়াখালীর ১০টিরও বেশি কারাতে ক্লাব ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। দেশজুড়ে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী তাঁর। এদের মধ্যে ৩৫০ জন ব্ল্যাক বেল্টধারী। খেলা পরিচালনা করতে গিয়েছেন ভারতের দিল্লি, পুনে, মুম্বাই ও হায়দরাবাদে।
কারাতের পাশাপাশি এ পর্যন্ত ১৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রুবেল, সোহেল রানা, ড্যানি সিডাক ও ইলিয়াস কোবরা অভিনীত বজ্রমুষ্টি। এই সিনেমায় অন্যতম প্রধান চরিত্র মং–এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। অ্যাকশন ওয়ারিয়র নামে চলচ্চিত্রের অ্যাকশন পরিচালনা দলও আছে তাঁর। বাড়ি রাঙামাটির চন্দ্রঘোনায় হলেও পেশাগত কাজে সপ্তাহে চার দিন থাকেন নগরের ব্যাটারি গলির বাসায়।
কথায় কথায় জানা হলো ওস্তাদের কথা। কারাতে শেখার পেছনের কাহিনিটাও গড়গড় করে বলে চলেন শিহান রতন।
বাবা অধীর রঞ্জন তালুকদার ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাবা তাঁকে ১০ টাকা দিতেন সিনেমা দেখতে। আর তেমন এক দিনে মর্নিং শোতেই দেখা হলো ব্রুস লির সঙ্গে। এন্টার দ্য ড্রাগন দেখে ব্রুস লির ভক্তই বনে গেলেন। চেষ্টা করলেন নিজেও ব্রুস লি হয়ে ওঠার। ১৯৭৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ার সময় ভর্তি হয়ে যান মং হ্লা ফের বার্মিজ বেন্ডো কারতের ক্লাসে। এরপর আজ অবধি আছেন মার্শাল আর্টের সঙ্গে। ব্রুস লি তাঁর প্রেরণা, মং হ্লা ফে ছিলেন গুরু। তবে এখন জাপানি কারাতে গুরু গিচিন ফুনাখুশি উদ্ভাবিত মার্শাল আর্টের অনুসারী তিনি। আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, অপরকে সম্মান করা ফুনাখুশির কারাতের মূল দর্শন। আর রতনও কারাতেকে নিখাদ একটি খেলা হিসেবেই দেখেন এখন।