চরের শিশুদের কাঠ-কাদামাটি-রঙের ভিন্নতর শহীদ মিনার উৎসব
ছোট ছোট শিশুরা নিজেদের সারা বছরের টিফিনের টাকা থেকে একটা অংশ বছর ধরে জমায়। অপেক্ষায় থাকে কবে একুশে ফেব্রুয়ারি আসবে। সেদিন তারা দলে দলে ভাগ হয়ে শহীদ মিনার বানাবে, মনের মাধুরী দিয়ে রং ও রঙিন কাগজ দিয়ে বাহারি রঙে সাজাবে। সারা দিন হইহুল্লোড়ে কাটাবে। শিশুদের এই আনন্দে শামিল হন তাদের অভিভাবকেরাও। চাঁদা তুলে তাঁরাও শিশুদের জন্য ভালো–মন্দ রান্না করেন, সবাই মিলে খান।
বরিশাল নগরের রসুলপুর চরের শিশুরা মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে কয়েক বছর ধরে এমন আয়োজন করে আসছে। তাদের আয়োজনে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, নৃত্য, আবৃত্তি, পুরস্কার বিতরণসহ নানা অনুষ্ঠান। এই শিশুদের প্রায় সবাই দরিদ্র আর নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা।
এবারও চরের দরিদ্র শিশুরা ১৫টি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে। পুরো আয়োজনকে উৎসাহিত করতে সেরা শহীদ মিনার বাছাইয়ের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।
বরিশাল নগরের রসুলপুর চরটি নগর থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। করোনা মহামারির কারণে সারা দেশের মতো এখানকার স্কুলও বন্ধ। কিন্তু তাতে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজনে ছেদ ধরাতে পারেনি। দুই দিন ধরে চরের শিশুরা লেগে যায় কাদা, মাটি, রং, কাগজ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরির কাজে। একে একে মূর্ত হয়ে নানা রঙের বাহারি স্মৃতির মিনার। এবারও শিশুরা এই চরে ১৫টি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে। পুরো আয়োজনকে উৎসাহিত করতে সেরা শহীদ মিনার বাছাইয়ের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, এই আয়োজনের সূত্রপাত বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার সদস্যসচিব চিকিৎসক মনীষা চক্রবর্তীর হাত ধরে। ৯-১০ বছর আগে শহীদ মিনার নির্মাণের এমন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এর পর থেকে প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই কীর্তনখোলা নদীর তীরে রসুলপুর কলোনিতে ভিন্ন এক আয়োজন। পুরো আয়োজনটি শিশুদের কেন্দ্র করে হলেও ছোট-বড় সবাই এতে সহায়তা করেন। মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ, সৃজনশীলতার বিকাশে এই আয়োজন এখন এই চরের শিশুদের কাছে এক প্রতীক্ষিত এক উৎসব।
সোনিয়া বেগম নামে স্থানীয় এক গৃহবধূ বলেন, মনীষা আপা নিজে থেকে এ প্রতিযোগিতার পুরস্কারের অর্থ দেন প্রতিবছর। এই প্রতিযোগিতায় যে শিশুরা কেবল শুধুই শহীদ মিনার তৈরি করে, তা নয়। শিশুরা এর মধ্য দিয়ে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের জীবন, আত্মত্যাগ সম্পর্কেও জানতে পারে।
আয়োজক শিশুরা বলে, যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তারা প্রতিবছর এই শহীদ মিনার নির্মাণ করে। মৌমিতা (১৩) নামের এক শিশু বলে, ‘অনেক বছর ধরে আমরা শহীদ মিনার তৈরি করি। এই দিন আমাদের খুব ভালো লাগে। গান, নাচ, ছবি আঁকা—কত অনুষ্ঠান হয়। সবাই মিলে আনন্দ করি।’ আরেক শিশু সুমাইয়া (১৩) বলে, ‘আমরা চরের সব শিশু এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করি। বাঁশ, রঙিন কাগজ, কাঠ, রং, কাদামাটি দিয়ে আমরা শহীদ মিনার বানাই। ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের সম্মান জানাই। আমাদের বাবা-মায়েরাও এতে অংশ নেয়।’
এবারের আয়োজনেও উপস্থিত ছিলেন মনীষা চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহরে নানা ধরনের আয়োজন করা হয়। যেখানে শহরের মানুষই অংশ নেন। কিন্তু সমাজের কথিত মূলস্রোতের বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী এই আয়োজনের বাইরে থাকে বলে মাতৃভাষা, দেশপ্রেমের এই সুমহান পাঠ থেকে বঞ্চিত হন। ফলে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরাও ভবিষ্যতে সমাজের মূলধারায় খাপ খাওয়াতে পারে না। তাদের মনন আর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে না। এসব চিন্তা করেই আমরা বিচ্ছিন্ন রসুলপুর চর এলাকায় ৯ বছর ধরে শহীদ মিনার নির্মাণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছি। পাশাপাশি এখানকার শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি।’
মনীষা বলেন, ‘এটি দরিদ্র অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার শিশুরা প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠে। এখানে মাদক, সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটেছে এবং ফলে এখানকার শিশু এবং তরুণসমাজ অন্ধকার জগতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা মনে করি, এ ধরনের আয়োজন শিশুদের মানসিক বিকাশ, বেড়ে ওঠা, দেশপ্রেম সৃষ্টির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা মনে করি, বাচ্চারা যখন কাঁচা হাতে এ শহীদ মিনারগুলো বানায়, তখন তাতে যে মমতা থাকে, ইতিহাস জানার যে আগ্রহ থাকে, সেই আগ্রহ আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাটা ভেতরে প্রথিত হয়। আর ৯ বছর ধরে চলা এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এখানকার মানুষের মধ্যে ইতিহাসবোধ, সৃজনশীলতা, সচেতনতা, অনন্য জীবনবোধ ও মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে তা অভাবনীয়। এ জন্য আমরা এ কাজটি অব্যাহত রাখতে চাই।’