বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের অবরোধে নাশকতার কারণে গাইবান্ধায় গত মঙ্গলবার গভীর রাতে পদ্মরাগ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে অজ্ঞাতনামা চার যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক যাত্রী। দুই দফা অবরোধে নাশকতায় সম্পদহানি এবং বগি লাইনচ্যুত হয়ে শতাধিক যাত্রী আহত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির ঘটনা এই প্রথম।
গাইবান্ধার বোনারপাড়ায় ফিশপ্লেট খুলে ফেলার কারণে পদ্মরাগ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়েছে। একই রাতে একই ধরনের নাশকতায় খুলনা ও চাঁদপুরেও ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ অক্টোবর থেকে বিরোধী দলের হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি শুরুর পর গতকাল বুধবার পর্যন্ত রেলে প্রায় ২৪৪টি নাশকতা হয়েছে। এর অধিকাংশই হয়েছে দুই দফার অবরোধ কর্মসূচিতে।
পদ্মরাগ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয় বগুড়ার সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথের বোনারপাড়ায়। সান্তাহারে গত কয়েক দিনেও নাশকতা ঘটে। লাকসাম-চাঁদপুর পথে মঙ্গলবার রাতে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেন নাশকতার শিকার হয়ে লাইনচ্যুত হয়। এ পথে গত ২৬ নভেম্বর থেকে চার-পাঁচবার নাশকতার শিকার হয়েছে মেঘনা ট্রেনটি। খুলনায় রেলপথে সবচেয়ে বড় নাশকতা গতকালই হয়।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া রেলস্টেশনের কাছে বুরুঙ্গি রেলসেতুর মুখে দুর্বৃত্তরা বেশ কিছু জায়গার ফিশপ্লেট খুলে রাখে। মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে পদ্মরাগ ট্রেনটি ওই স্থানে এলে ইঞ্জিন ও তিনটি বগি নিয়ে লাইনচ্যুত হয়। ইঞ্জিনটি রেললাইন থেকে পাশের নিচু জমিতে পড়ে যায় এবং ইঞ্জিনের পরের বগিটি সরাসরি ইঞ্জিনে ধাক্কা খেয়ে লেপটে যায়। এতে বগির ভেতরই একজন নারীসহ অজ্ঞাতনামা চারজন মারা যান। ওই বগিতে অনেক যাত্রী আটকা পড়েন। তাঁদের চিৎকার-আহাজারিতে সেখানে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। গতকাল সারা দিনে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও রেলকর্মীরা বগির বিভিন্ন অংশ কেটে যাত্রীদের উদ্ধার করেন। লাইনচ্যুত অন্য দুটি বগি খাদে পড়ে যায়নি।
দুর্ঘটনার পর লালমনিরহাট-সান্তাহার পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, পদ্মরাগের ইঞ্জিনটি সেতুর গোড়ায় খাদে পড়েছে। সেতুতে দুর্ঘটনা ঘটলে বগি পানিতে পড়ে গেলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রেলকর্মীরা জানান, হতাহতদের বেশির ভাগই ইঞ্জিনের পরের বগির যাত্রী ছিলেন। লাইনচ্যুত হওয়ার সময় ইঞ্জিন ও এর পরের বগির মধ্যে সজোরে ধাক্কা লেগে একটি আরেকটির ওপর পড়ে। এ জন্যই প্রাণহানি ঘটেছে।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক দিনে বিভিন্ন রেলপথে কয়েকটি ট্রেন লাইনচ্যুত হলেও ইঞ্জিনের সঙ্গে অন্য বগির ঘষা কিংবা ধাক্কা লাগেনি। এ জন্যই ওই সব ঘটনায় প্রাণহানি হয়নি।
বোনারপাড়ার নাশকতার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এলাকাবাসী সাদ্দাম হোসেন (২২) ও দুদু মিয়া (২৫) নামের দুজনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছেন। তাঁদের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া গ্রামে।
ওই নাশকতার ঘটনা তদন্তে রেলের লালমনিরহাট অঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গতকাল চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ফিশপ্লেট খুলে ফেলার কারণে মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে খুলনার ফুলতলা উপজেলার যুগ্নিপাশায় আন্তনগর নকশীকাঁথা ট্রেনের ইঞ্জিনসহ পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ইঞ্জিনসহ ছয় বগির ট্রেনটি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে খুলনা যাচ্ছিল। সর্বশেষ বগি লাইনচ্যুত হয়নি। এর পর থেকে খুলনার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ইঞ্জিন ও একটি বগি উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, যুগ্নিপাশা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের প্রভাব বেশি। নকশীকাঁথা যেখানে লাইনচ্যুত হয়, এর আশপাশেই একটি বড় মেহগনিগাছ কাটা অবস্থায় দেখা যায়। তাঁদের ধারণা, ফিশপ্লেট খোলার পাশাপাশি দুর্বৃত্তরা রেললাইনে গাছের গুঁড়িও ফেলতে চেয়েছিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফিশপ্লেট খুলে ফেলার কারণে রেলের লাইন দুটি স্লিপার-পাথর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। লাইনচ্যুত একটি বগির ওপর করাত দিয়ে কাটা মেহগনিগাছ পড়ে আছে।
লাইনচ্যুত ট্রেনের যাত্রী ও সবজি ব্যবসায়ী আকরাম শেখ বলেন, ‘সিটে শুয়ে ঝিমাচ্ছিলাম। এর মধ্যে বিকট শব্দ করে ট্রেন কাত হয়ে গেল।’
ট্রেনের সহকারী লোকোমাস্টার (চালকের সহকারী) আকতারুজ্জামান বলেন, উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাঁরা ট্রেনটি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে চালাচ্ছিলেন। ইঞ্জিন থেকে ফিশপ্লেট তুলে ফেলার বিষয়টি বোঝা যায়নি।
ওই দুর্ঘটনার কারণে এ পথে চলাচলকারী সুন্দরবন, রূপসা, সীমান্ত, চিত্রা ও রকেট এক্সপ্রেস যশোর স্টেশনে আটকা পড়ে। খুলনা থেকে ছেড়ে যেতে পারেনি একটি কমিউটার ট্রেনও।
চাঁদপুরের শাহতলীতে গতকাল ভোর পাঁচটা ৩৮ মিনিটে মেঘনা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রামের যাচ্ছিল। এ দুর্ঘটনার কারণে চাঁদপুর-চট্টগ্রাম পথে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।
চাঁদপুর জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুভাষ কান্তি দাস বলেন, রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় যাত্রীবাহী ওই ট্রেনটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে ১৩টি বগি ছিল।
লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে একাধিকবার নাশকতায় জিআরপি পুলিশ দেড় হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে পাঁচটি মামলা করেছে। এ পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হবিগঞ্জের বাহুবলের রশিদপুরে রেললাইনে আগুন দেওয়ায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটা থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এ সময় সিলেট থেকে ঢাকামুখী সুরমা এক্সপ্রেস শ্রীমঙ্গলে ও আন্তনগর উপবন এক্সপ্রেস কুলাউড়া স্টেশনে আটকা পড়ে। ঢাকা থেকে সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে আটকা পড়ে।
গাজীপুরের শ্রীপুরের সাতখামাইর স্টেশনের কাছে রেলপথে অগ্নিসংযোগ ও গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করলে মঙ্গলবার রাতে প্রায় এক ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। আনসার ও পুলিশ সেখানে গেলে অবরোধকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন যোগ দিয়ে ধাওয়া করলে অবরোধকারীরা পালিয়ে যান।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন গাইবান্ধা, খুলনা, চাঁদপুর, গাজীপুর ও হবিগঞ্জ প্রতিনিধি।]