সাক্ষাৎকার
গণতান্ত্রিক শাসনের অভাবে গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়
গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? রাষ্ট্রের নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, এসব প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রতিক আন্দোলনে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ–এর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে—সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রতিক আন্দোলনে বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এর পেছনের কারণগুলো কী বলে মনে করেন?
এম আবদুল্লাহ: যখন গণতান্ত্রিক শাসনের অভাব দেখা দেয়, তখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর খড়্গ নেমে আসে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে একতরফা জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কঠোর হয়েছে। ২০১৮ সালের পর পরিস্থিতি আরও অসহিষ্ণু হলো। আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোনো না কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যাবেই। সেটি সরকারের কোনো গোষ্ঠী বা অন্য যেকোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী হতে পারে। তখন তারা গণমাধ্যমের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। রোজিনা ইসলামের ওপর নিগ্রহের বিরুদ্ধে সাংবাদিকেরা যাঁর যাঁর জায়গা থেকে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁকে মুক্ত করার মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। রোজিনা এখানে প্রতীকমাত্র। তিনিসহ মুক্তচিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে যাঁরাই ক্ষমতাশালীদের নিগ্রহের শিকার হবেন, তাঁদের সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি বাধাগুলো কী?
এম আবদুল্লাহ: সব সরকারের সময়ই সংবাদকর্মীরা কমবেশি আক্রান্ত হন, নিপীড়নের শিকার হন। জনগণের রায়ের প্রতি যখন নির্ভরতা কমে যায়, তখন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম—দুটোই হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সরকারকে সহযোগিতা করে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকার প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। করোনাকালের ত্রাণ তৎপরতার কথা যদি বলি, শুরুতে একধরনের লুটপাট দেখা গিয়েছিল। পরে এ নিয়ে গণমাধ্যম ব্যাপকমাত্রায় সরব হলে সেই লুটপাট অনেকটা কমে আসে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যম সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারলে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আসে সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সুশাসনের ঘাটতি এবং গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব স্বাধীন সাংবাদিকতায় কতটা বাধা তৈরি করছে?
এম আবদুল্লাহ: গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম হাত-ধরাধরি করে চলে। যখন গণতন্ত্র থাকবে না, তখন গণমাধ্যম আক্রান্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ প্রবণতা বৈশ্বিক, তবে বাংলাদেশের অবস্থা আরও নাজুক। এখানে সহনশীলতার অভাব একটা বড় কারণ। সরকারে সহনশীলতার অভাব থাকলে এর প্রভাব সব জায়গায় পড়ে। কিছু আমলা গণমাধ্যমের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব রাখেন। এ ছাড়া ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের অনুসারীরাও অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রচারের পর নানাভাবে সাংবাদিকদের হয়রানি-নির্যাতন করেন। গত বছর ১৫৯ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই নিগ্রহের শিকার হয়েছেন সরকারদলীয় বা তাদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে। এসব ঘটনায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ কাজ করে। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এসব শ্রেণির স্বার্থে আঘাত হানে। তাই তাদের এত আক্রোশ। আর তাদের হাতে যেসব অস্ত্র আছে, সেগুলোর প্রয়োগ করে। আর এর সঙ্গে সরকারি সহায়তা পেলে তা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ফেসবুকে খণ্ডিত প্রচারণা চলছে। সরকারি ব্যয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলো। কী বলবেন এ পরিস্থিতি নিয়ে?
এম আবদুল্লাহ: রোজিনা ইসলাম যখন আটক ও কারাবন্দী ছিলেন, তখন তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল না। সেই সময় রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে তাঁর বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। এটা জঘন্য অপরাধ। তাঁর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যেভাবে অপপ্রচার করা হচ্ছে, তা চরম অন্যায্য কাজ। শুধু রোজিনা ইসলাম নন, সাধারণ নাগরিকেরও ব্যক্তিগত জীবনের কথোপকথন প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। এটা সভ্যতার সীমা লঙ্ঘন করে। সব সামাজিক শক্তিকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।