উগ্রবাদবিষয়ক গবেষকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক রিজলভের বাংলাদেশ বিষয়ে জরিপ
গণতন্ত্র ও শরিয়াহ আইন: জনমত দুটিরই পক্ষে
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র সমর্থন করে। কিন্তু অনেকে বিশ্বাস করে, কোরআন ও হাদিসভিত্তিক শরিয়াহ আইন ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক। সহিংস উগ্রবাদবিষয়ক গবেষকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক রিজলভের জরিপে এটা এসেছে।
জরিপে দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একটি মর্মবস্তু হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব। তবে ৮০ শতাংশের বেশি মনে করেন, শরিয়াহ আইন মৌলিক সেবা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করে।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে জরিপকারী গবেষকেরা বলেছেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শরিয়াহ আইন একই সঙ্গে থাকতে পারে বলে মানুষ মনে করছে।
রিজলভ নেটওয়ার্ক হচ্ছে গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি বৈশ্বিক কনসোর্টিয়াম। এরা সহিংস উগ্রবাদ নিয়ে ২৫টির বেশি দেশে গবেষণা করে। এর প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। এ বছরের ১২ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৬৭টি পরিবারে তারা জরিপ করেছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে এসব পরিবার বাছাই করা হয়। উত্তরদাতাদের ৫০ শতাংশ পুরুষ ও ৫০ শতাংশ নারী। তাঁদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতার বসবাস গ্রামে।
এই জরিপের ওপর ভিত্তি করে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড শরিয়াহ ইন বাংলাদেশ: সার্ভেইং সাপোর্ট’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রিজলভ নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটে গতকাল সোমবার মধ্যরাতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিকস অ্যান্ড গভর্নমেন্টের অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী সৈয়দা সেলিনা আজিজ।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহিংস উগ্রবাদ নিয়ে জরিপ ছাড়াও রিজলভের আরও গবেষণাকাজ আছে। এসব গবেষণা থেকে আমরা গণতন্ত্র, শরিয়াহ আইন, সহিংস উগ্রবাদ—এসব বিষয়ে মানুষের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করেছি। আমাদের লক্ষ্য এ বিষয়ে নীতিনির্ধারক, একাডেমিকসহ নানা স্তরের মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া। তাহলে এসব বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হবে।’
জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, সম্পত্তির অধিকার, নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশ ও সম্মিলনের স্বাধীনতার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকারকে সমর্থন করেন। ৯১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একটি বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব। ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন। উত্তরদাতারা বাকস্বাধীনতা (৭৬ শতাংশ) ও সংগঠন করার অধিকার (৭৫ শতাংশ) গণতন্ত্রের জন্য তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে পুরুষ উত্তরদাতারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
ফলাফল বিশ্লেষণকারী দুই গবেষক মনে করেন, বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থার মধ্যে শরিয়াহ আইনের ভূমিকা রাখার ব্যাপারে উত্তরদাতাদের সমর্থন আছে। ৮০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা মনে করেন, শরিয়াহ আইন মৌলিক সেবা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সহায়ক এবং শরিয়াহ আইন থাকলে দেশে দুর্নীতি কমবে। তাঁদের বড় অংশটি এটা বর্ণনা করেছেন যে গুরুতর শারীরিক শাস্তির বিধান শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের একটি মূল বিষয়। প্রায় ৭৮ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন যে শরিয়াহ আইন নারীকে পর্দা, হিজাব বা নিকাব পরতে বাধ্য করবে।
এর আগে ২০১১-১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপেও এসেছিল, বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ৮২ শতাংশই শরিয়াহ আইনের পক্ষে। ওই জরিপে এসেছিল, এ দেশের ধর্ম পালনকারী মুসলমানদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ এমন আইন চান। অন্যদিকে ধর্ম পালনে নিয়মিত নন এমন ৭৯ শতাংশ ব্যক্তিও শরিয়াহ আইনের পক্ষে।
রিজলভ নেটওয়ার্কের জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণকারী গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজে ও শাসনব্যবস্থায় ইসলামিক মূল্যবোধ ও চর্চার চাহিদা আছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ পথ নেয় এবং বিচারব্যবস্থার জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন ধরে রাখে। ১৯৭২ সালের সংবিধান ধর্মের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং একের ধর্ম অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে বাধা দেয়। বর্তমানে দেশে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক হচ্ছে। ইসলামি দল বা গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছে।
জরিপে উত্তরদাতাদের কাছে গণতন্ত্র ও শরিয়াহ আইন বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল জনগণ কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমর্থন করে? করে থাকলে কোন মাত্রায়? দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা সম্পর্কে ধারণা কী? শরিয়াহ আইনে চলা একটি সরকার সম্পর্কে সাধারণ ধারণা কী? সুশাসন নিশ্চিত করতে মূল উপাদান হিসেবে শরিয়াহ আইনকে কোন মাত্রায় মানুষ বিবেচনা করে? শরিয়াহ আইনকে শাস্তিদানকারী পদ্ধতি হিসেবে মানুষ কতটুকু বিবেচনা করে? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমর্থনকারী মানুষ কি বিশ্বাস করে যে শরিয়াহ আইন বাংলাদেশের জন্য অধিকতর সুশাসন নিশ্চিত করবে? শরিয়াহ বিষয়ে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির শিক্ষার কী ভূমিকা আছে?
গবেষকেরা বলেছেন, এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে গণতন্ত্রের ব্যাপারে সমর্থন কতটা জোরালো, তা অনুধাবন করা যায়, বোঝা যায় গণতন্ত্রের জন্য কোন বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দেয়, শাসনব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণাও এ থেকে পাওয়া যায়। সাধারণ আইনি ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে শরিয়াহ আইনকে দেখছে কি না, তা-ও এ থেকে বোঝা সম্ভব।
জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আছে। অনেক নাগরিক মনে করেন না, তাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা ঠিকভাবে শাসিত হচ্ছেন। তাঁরা অনুভব করেন, তাঁদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ নাগরিক সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চান না।
গবেষকেরা বলেছেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হতে না পেরে অনেকে বিকল্প অনুসন্ধান করছেন, বিকল্পের মধ্যে শরিয়াহ আইনও আছে। মানুষ এটা চায় সুশাসন নিশ্চিত করতে এবং দুর্নীতি কমাতে। এই জরিপে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মতামতও নেওয়া হয়েছিল। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী শরিয়াহ আইন মেনে নেওয়ার পক্ষে নয়, তবে অপরাধ কমাতে শারীরিক নির্যাতনের মতো বিষয়কে তাদের একটি অংশ সমর্থন করে। পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন বেশি। আর শরিয়াহ আইনের প্রতি দুর্বলতা নারী ও গ্রামের মানুষের বেশি।
জরিপকারী দুই গবেষক বলেছেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মনে করছেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শরিয়াহ আইন একই সঙ্গে থাকতে পারে। জরিপে এ-ও দেখা গেছে যে দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, বিচারব্যবস্থার দুর্নীতি এবং ক্রমহ্রাসমান মৌলিক অধিকারের উপলব্ধি থেকে মানুষ বিকল্প শাসনপদ্ধতি হিসেবে শরিয়াহ আইনকে দেখতে শুরু করেছে। তবে এ বিষয়ে বড় আকারের গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন এই গবেষকেরা।