ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি তাড়া করে ফিরছে আইলাদুর্গতদের

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন দেউলীসুবিদখালীর মেহেন্দীয়াবাদ গ্রামের বাসিন্দা পিয়ারা বেগম (৪০)। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার এই নারী ২০০৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সংগ্রাম নামের একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে গরু কেনার জন্য ছয় হাজার ৭৫০ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে দেড় শ টাকা করে কিস্তি পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ওই বছরের ১৫ নভেম্বর সিডরের আঘাতে পিয়ারা বেগমের স্বামী আলী হোসেন মুন্সি মারা যান। সিডরে ভেসে যায় ঋণের টাকায় কেনা পিয়ারার গাভীটিও। পিয়ারা বেগম জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর মানুষের বাড়িতে কাজ করে, কখনো ধারদেনা করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। কিন্তু আইলার আঘাতে আবারও লণ্ডভণ্ড হয় এলাকা। জীবিকার সব পথ বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। তিনি দাবি করেন, তাঁর সঞ্চয় থেকে তিন হাজার টাকা কেটে নেয় সংগ্রাম। এখনো তিনি ওই সংস্থার কাছে পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা দেনা। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে ১১ হাজার ৬৫ টাকার ঋণ রয়েছে তাঁর। এনজিওর মাঠকর্মীরা প্রায়ই তাঁকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য তাগাদা দিতে আসেন। সরকার আইলায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলোয় কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ আদায় এক বছরের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত ১ জুলাইয়ের একটি স্মারকে সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলোকে চলতি বছরের ২৮ জুন থেকে কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ আদায় পরবর্তী এক বছরের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণসহ সব পাওনা পরবর্তী এক বছরের জন্য পুনঃতফসিল করার নির্দেশ দেওয়া হয় ওই স্মারকে। ঋণগ্রহীতারা যাতে হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয় স্মারকে। কিন্তু এনজিওগুলো এই নির্দেশ অমান্য করে ঋণের কিস্তি আদায় করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার যে কিস্তি আদায় বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে মেহেন্দীয়াবাদ গ্রামের লোকজন সে খবরই জানে না। এদিকে কিস্তি আদায় করতে এসে মাঠকর্মীরা গ্রামবাসীকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন বলে তারা অভিযোগ করেছে। গ্রামের শেফালী বেগমও (৪৫) একাধিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। ঋণের টাকা কৃষিকাজে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে ফসল হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। এনজিওর মাঠকর্মীদের চাপে তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেউলীসুবিদখালীর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোবারক আলী মুন্সি জানান, সিডর ও আইলায় এই ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিডরে ৮৫ জন মানুষ মারা গেছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। আর আইলাতেও ফসলের সর্বনাশ হয়েছে। ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষই ক্ষুদ্রঋণের ওপর নির্ভরশীল। ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধের নির্দেশ থাকলেও অনেকে তা মানছে না। দুর্গত এই মানুষদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগের ঋণের কিস্তি বন্ধ রেখে নতুন করে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।এদিকে সংগ্রামের মির্জাগঞ্জ উপজেলার শাখা ব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন ও উদ্দীপনের শাখা ব্যবস্থাপক নীহাররঞ্জন রায় জানান, যদি কেউ স্বেচ্ছায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে তাহলেই তা গ্রহণ করা হয়। কাউকে চাপ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে কিস্তি আদায়ের কথা অস্বীকার করেছেন তাঁরা। মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় এক বছরের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই কোনোভাবেই কিস্তি আদায় করা যাবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কিস্তি আদায়ের এমন অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।