‘ক্ষতিপূরণ পেলেও খাদিজার ক্ষতি অপূরণীয়’
শিশু বয়সে খাদিজা গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সে সময় পুলিশের কাছ থেকে প্রতিকার পাননি খাদিজা। এ ঘটনায় সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তিনি। ক্ষতিপূরণের অর্থের চেক তাঁর হাতে তুলে দেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সীমা রানী ধর। এ প্রসঙ্গে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্ততপক্ষে একজন তো ক্ষতিপূরণ পেলেন। তবে খাদিজা ক্ষতিপূরণ পেলেও তাঁর ক্ষতি অপূরণীয়।’
ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০ হাজার টাকার চেক গত সোমবার খাদিজার হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরদিন মঙ্গলবার ইউএনও সীমা রানী ধর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্যাতনের একটি ঘটনাও ঘটুক, তা কেউ চায় না। প্রশাসন নির্যাতন বন্ধে তৎপর। তারপরও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলছে। তবে নির্যাতনের ঘটনায় খাদিজা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, এটা একটি ভালো দিক।’
২০১৩ সালে ঢাকার মিরপুরে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তখনকার শিশু গৃহকর্মী খাদিজা। মিরপুরের গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পুলিশ যখন তাকে উদ্ধার করে, তখন বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল। এ নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
গৃহকর্তার বাড়ি থেকে উদ্ধারের পর খাদিজা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১৮ দিন। তখন খাদিজার শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। শিশু খাদিজাও তখন জানিয়েছিল, তাকে প্রায়ই মারধর করা হতো। তাকে গরম ইস্তিরি দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল।
তবে পরে পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদিজাকে কেউ মারধর করেনি।
নয় বছর আগের সেই ঘটনায় খাদিজা এখন ক্ষতিপূরণ পেলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমন ঘটনায় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কেউ ক্ষতিপূরণ পেলেন।
খাদিজা এখন এক সন্তানের মা। তিনি এখন স্বামীর সঙ্গে বরিশালে থাকেন।
খাদিজার বাবা টিটু মিয়া ঢাকায় রিকশা চালান। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, খাদিজা যখন চেক আনতে ভান্ডারিয়ায় যান, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
টিটু মিয়া জানান, খাদিজার বয়স যখন তিন বছর, তখন বন্যায় ঘরচাপায় মা ও এক ভাই মারা যান। খাদিজার বয়স যখন সাত থেকে আট বছর, তখন এক নারীর মাধ্যমে তাকে ঢাকার এক বাসায় কাজে দেন। খাদিজাকে তখন বেতন দেওয়া হতো মাসে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। গৃহকর্ত্রী খাদিজাকে মারধর করতেন। খেতে দিতেন না।
খাদিজার ওপর নির্যাতনের ঘটনায় যথাযথ প্রতিকার চেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেছিল বেসরকারি সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (সিসিবি)।
কমিশন খাদিজার নির্যাতনের বিষয়ে মামলা না নেওয়ায় পুলিশের মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন খুঁজে পায়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বারবার চিঠি দিয়ে তদন্ত করতে বলে কমিশন। চিঠি চালাচালিতে পার হয়ে যায় ছয় বছর।
কোনো প্রতিকার না পেয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিসিবির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করা হয়।
২০১৯ সালে হাইকোর্ট রায়ে মন্তব্য করেন, মানবাধিকার কমিশন আইনে অর্পিত দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে। মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে’।
হাইকোর্টের রায়ে ৬০ দিনের মধ্যে খাদিজার ওপর নির্যাতনের বিষয়ে শুনানি করে প্রতিকার দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
২০২০ সালে কমিশনের শুনানিতে খাদিজা বলেছিলেন, তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি বিচার চান।
নির্যাতনের বিষয়ে খাদিজাসহ পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে শুনানি শেষে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করে কমিশন। এ ছাড়া খাদিজার বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন করে যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর সুপারিশ করে কমিশন।
কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-এ উল্লেখ করা হয়, খাদিজা শিশু বয়সে নির্যাতনের শিকার হলেও বর্তমানেও সেই নির্যাতনের ক্ষত তাঁর মনে দাগ কেটে আছে। তাই খাদিজাকে ৫০ হাজার টাকার সাময়িক সাহায্য করার সুপারিশ করা হয়।
কমিশন তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দিতে সুপারিশ করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার খাত ছিল না। কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট খাত সৃষ্টির তাগাদা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এ ক্ষতিপূরণ দেয়।
গত মঙ্গলবার ইউএনও সীমা রানী ধর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘খাদিজার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। জাতীয় পরিচয়পত্রও নেই। তবে তাঁর জন্মনিবন্ধন সনদ আছে। এই সনদ দিয়েই তিনি যাতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, সে ব্যাপারে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করছি।’
খাদিজার ওপর নির্যাতনের ঘটনাটি আলোচনায় এসেছিল ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি সংবাদের সূত্র ধরে। ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘ডমেস্টিক হেল্প টর্চারড’। প্রতিবেদনটি দেখে সিসিবি খাদিজার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার চেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নজরে এনেছিল।