কৃত্রিম পায়ে নতুন জীবনের স্বাদ
ছয় মাস বয়সী ছেলে সাফি আহমেদকে রেখে বাবা পাড়ি জমিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। চার বছর পর তিনি ফিরে আসছেন। মায়ের সঙ্গে সাফিও মিরপুরে খালার বাসায় এসেছে। মায়ের সঙ্গে সেও যাবে বিমানবন্দরে, বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। দুপুরে খালাতো ভাইবোনের সঙ্গে ছাদে খেলতে যায়। আচমকা একটি বৈদ্যুতিক তারে হাত পড়ে, হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ ছোট্ট শরীরে প্রবেশ করে। বাবা এসে দেখেন তাঁর একমাত্র সন্তানের হাত-পা দুটোই কেটে ফেলতে হয়েছে।
সাফির পরিবার কিন্তু হাল ছাড়েনি। তারা ঢাকা মেডিকেলে জানতে পারে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) মঈন ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বিনা মূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হচ্ছে। এখানে সাফির পা লাগানো হয়েছে। আমরা সরেজমিনে যেদিন গেলাম, সেদিন চলছিল হাত লাগানোর প্রক্রিয়াও।
নিটোর অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতালের নিচতলার একটি অংশে পুরোটায় চলছে কৃত্রিম পা লাগানোর প্রক্রিয়া। বাইরে অপেক্ষায় বসা নানা বয়সী অনেক মানুষ। এক হাজারের বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন। মঈন ফাউন্ডেশনের পরিচালক সাদিয়া মঈনের কাছে একটু পরপর অনুরোধ নিয়ে আসছিলেন কেউ কেউ। প্রত্যেকের কথা তিনি হাসিমুখে শোনেন, সুন্দর করে আশ্বস্ত করেন—এ বছর না পারলে পরের বছর নিশ্চয় করে দেবেন। আশা নিয়ে তাঁরা ফিরে যান। ‘প্রতিদিন আমি একবার করে এখানে আসি। কাউকে ফেরাতে ইচ্ছে করে না। কাউকে যখন “না” বলি, তখন সারা দিন মন খারাপ থাকে।’ বলছিলেন সাদিয়া মঈন।
২০১৫ সালে নিজেদের অর্থায়নে পারিবারিক উদ্যোগে মঈন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। জীবনের একটা বড় সময় তাঁর কেটেছে ভারতের জয়পুরে। ফলে জয়পুরের ভগবান মহাবীর বিকলাঙ্গ সহায়তা সমিতি—জয়পুর ফুট কৃত্রিম পা লাগানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সুনাম কুড়িয়েছে, সেটি তাঁর জানা ছিল। তাই বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাদের এনে সেই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একার চেষ্টায় বড় কিছু করা কঠিন হয়। সমাজের অনেকেই মঈন ফাউন্ডেশনের এ উদ্যোগের প্রশংসা করছেন। সাহায্যও করেছেন। সাদিয়া মঈন বলেন, চাইলে যে–কেউ তাঁদের পাশে থাকতে পারেন। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন ভালো কিছু করার জন্য।
তিন বছর ধরে জয়পুর ফুটের একটি দল দক্ষতার সঙ্গে সাদিয়া মঈনের সঙ্গে এ কাজ করছে। এ বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৭০০ জনের কৃত্রিম পা লাগানো হয়। কয়েকজনের কৃত্রিম হাতও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৫ জনের এই দলের প্রধান প্রকাশ ভান্ডারি বলেন, ‘আমাদের দলেও চারজন আছেন, যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছিল। তাঁরা এখন কাজ করছেন। ৪৭ বছর ধরে এই কাজ করি। এখনো যখন কেউ হেঁটে বাড়ি ফেরে, হোক না কৃত্রিম পা, মনটা ভরে যায়। আমরা শুধু পা লাগাই না, একজন মানুষকে তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিই।’
তিন বছরে প্রায় দুই হাজার জনের কৃত্রিম পা লাগিয়েছেন তাঁরা। তবে নতুন কিছু শরীরে যোগ হচ্ছে, তাই মনের জোর ঠিক রাখতে হবে। পরিবারের সমর্থনও খুব প্রয়োজন। কুমিল্লার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া প্রশান্ত সিংহ কৃত্রিম পা নিয়ে স্কুল করছে। শুধু তা-ই নয়, সাইকেলও চালাতে পারে প্রশান্ত সিংহ। তবে প্রশান্ত সিংহের বাবা বলেন, ‘বাড়ন্ত শরীর তো, তখন পা পরিবর্তনের দরকার হয় প্রতিবছর। তাঁরা সব সময় এখানে থাকতে পারলে ভালো হতো, যখন দরকার, তখনই আসতে পারতাম।’
সাদিয়া মঈন নিজেও এটি নিয়ে কাজ করতে চান। ‘বহু মানুষের এটি দরকার। এক মাসের ক্যাম্প দিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমরা চাই সারা বছর এটি চলুক। সরকারের অনুমতি ও সহায়তা পেলে এটি সম্ভব। নিটোরও আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।’
এর মধ্যে একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখা গেল। যখনই কারও পা লাগানো হচ্ছে, তিনি হেঁটে দেখাচ্ছেন। বাকিরা আনন্দ–উল্লাস করছেন। জীবনের নতুন মানে বোধ হয় এখানেই লুকানো।