কারখানায় আগুনের মুখে ভাইকে ফোনে শেষ আকুতি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডসের কারখানায় যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন, সেই সময় চারতলায় আটকা পড়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের একজন শেষ মুহূর্তে বড় ভাইকে ফোন করেছিলেন। মর্মান্তিক এই ঘটনার দুই দিন পর ওই ভাইয়ের জবানিতে উঠে এসেছে কারখানাটিতে জ্যেষ্ঠ অপারেটর হিসেবে কাজ করা মোহাম্মদ আলীর সেই সময়ের আকুতি।
আগুন নেভানোর পর কারখানা ভবনটির ওই চারতলা থেকেই শুক্রবার দুপুরে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ছোট ভাই মোহাম্মদ আলীকে (২৮) আর জীবিত পাওয়ার আশা নেই পাবনার সুজানগরের বাসিন্দা মিজানুর রহমানের।
শনিবার গ্রাম থেকে বাবাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন ডিএনএ নমুনা দেওয়ার জন্য। ভাইয়ের লাশটা অন্তত পেতে চান তাঁরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ভাইয়ের শেষ ফোনের কথা প্রথম আলোকে বলেন তিনি।
মোহাম্মদ আলীর সেই সময়ের কথা উদ্ধৃত করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ভাই, আমার চারপাশে আগুন আর ধোঁয়া, আমি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমি মরে যাচ্ছি, আমারে মাফ করে দিয়ো। আমার ছেলেকে (আড়াই মাস বয়সী সন্তান) দেখে রাইখো। ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমার। ওরে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ কইরো।’
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩ মিনিটে মোহাম্মদ আলী এই ফোন করেছিলেন বলে জানান বড় ভাই মিজানুর। কারখানায় আগুন লাগার ২০–২৫ মিনিট পর ছিল তাঁর এই ফোন।
মিজানুর রহমান জানান, কথার মধ্যেই কিছুক্ষণ পরে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর শত চেষ্টা করেও মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি মিজানুর।
তাঁর ভাষ্যমতে, তিন বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছিলেন মোহাম্মদ আলী। তাঁদের গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগরের গণশ্যামপুর গ্রামে। বাবার নাম শাহাদাত খান। দেড় বছর আগে মোহাম্মদ আলী বিয়ে করেন। আড়াই মাস বয়সী তাঁর একটি ছেলে রয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নাম সাদিয়া খাতুন। মোহাম্মদ আলী স্ত্রীকে নিয়ে রূপগঞ্জেই থাকতেন। ছেলের জন্মের কয়েক মাস আগে স্ত্রীকে পাবনা পাঠিয়ে দেন।
মিজানুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে যখন কথা বলছিলেন, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকটাই নিশ্চিত, ভাই আর বেঁচে নেই। এখন শুধু ভাইয়ের লাশটা পেতে চাই। পাবনা থেকে বাবাকে নিয়ে এসেছি ডিএনএ নমুনা দেওয়ার জন্য।’
ওই কারখানার সিঁড়ি ও ছাদে ওঠার পথে তালা লাগানো ছিল বলে অভিযোগ করেন মিজানুর। তিনি বলেন, ‘ফোনে আমি ভাইকে বারবার বলছিলাম, তুই একটু বের হওয়ার চেষ্টা কর। তখন সে বলছিল, নিচে যাওয়ার সিঁড়িতে তালা লাগানো। ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতেও তালা লাগানো। প্রায় ৫০ জনের মতো লোক এখানে আটকা পড়ে আছে। ফোনেই শুনছিলাম, তারা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। কথা বলার সময় হঠাৎ করেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।’
গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। এ ঘটনায় দগ্ধ ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে। এর আগে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
হাশেম ফুডস লিমিটেড সজীব গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কারখানায় আগুনে প্রাণহানির ঘটনায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাশেমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।