কান্না, আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাস
বুকটা জ্বইলা যাইতাছে। হ্যার মায়ে খবর পাওয়নের পর থেইক্যা কেবল কানতাছে। পোলারে দ্যাখতেও আইতে পারতাছে না।’ মাঝবয়সী হজরত আলী গতকাল বুধবার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন তাঁর একমাত্র ছেলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে।
এম-১ নম্বর বিছানায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে আছেন ১৮ বছরের সোলায়মান আলী। মুখমণ্ডল, ডান হাত আর বুকের এক পাশ ঝলসে গেছে আগুনে। সোলায়মান বাসচালকের সহকারী। চালক আল-আমিনের অবস্থা আরও গুরুতর। মুখ, বুক, পেটসহ তাঁর দেহের ২৫ শতাংশের বেশি পোড়া। একই ওয়ার্ডের ৫ নম্বর বিছানায় তিনি অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাজীপুরে তাঁদের বাসে ছোড়া বোমায় আগুন ধরে গেলে তাঁরা পুড়ে যান।
সোলায়মানের বাবা হজরত আলীও গাড়িচালক। ঢাকায় একজনের ব্যক্তিগত গাড়ি চালান। ছেলের আহত হওয়ার খবর পেয়েছেন গতকাল সকালে। তাঁদের বাড়ি চাঁদপুরে। সেখানে থাকে স্ত্রী আর ছোট দুই মেয়ে। সোলায়মানের মা ছেলের আহত হওয়ার খবর পেয়েছেন, কিন্তু অবরোধের কারণে আসতে পারছেন না।
সোলায়মান ও আল-আমিনকে মঙ্গলবার মাঝরাত নাগাদ বার্ন ইউনিটে আনা হয়। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় স্টাফ বাস চালান আল-আমিন। মঙ্গলবার কারখানা বন্ধের পর যাত্রী নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় গাজীপুর চৌরাস্তার সামনে তাঁদের বাসে হামলা হয়। বোমা ছোড়া হয়েছিল চালককে লক্ষ্য করে। ফলে আল-আমিনই বেশি দগ্ধ হয়েছেন। সোলায়মান পাশেই ছিলেন। তিনিও দগ্ধ হন।
গতকাল দুপুর ১২টা নাগাদ বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা গেল, আল-আমিন সংজ্ঞাহীন। সোলায়মানের সংজ্ঞা থাকলেও চোখ বুজে অচেতনের মতো পড়ে আছেন বিছানায়। ছেলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসহায় বাবা। তাঁর প্রশ্ন ছিল খুবই সহজ, তাঁরা তো মালিকের চাকরি করেন। মালিক চাইলে গাড়ি নিয়ে পথে নামতেই হবে। কে তাঁদের নিরাপত্তা দেবে? হামলার শিকার হলে কে দেবে ক্ষতিপূরণ?
ওই ওয়ার্ডে নতুন আরও একজনকে ভর্তি করা হয়েছে গতকাল। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার লাঙ্গলমুড়া গ্রামের আবদুল আজিজ। সিএনজিচালিত স্কুটারের চালক আজিজ ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যাত্রী নিয়ে মুহুরিহাটে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে তাঁর স্কুটারে পেট্রলবোমা ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। বোমাটি পড়েছিল তাঁর গায়ে। শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে স্কুটারটিও। তবে যাত্রীরা রক্ষা পেয়েছেন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন।
গতকাল পর্যন্ত বার্ন ইউনিটে সাম্প্রতিক সহিংসতায় আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৪ জন। এই ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল জানান, সবার অবস্থাই গুরুতর। তবে এঁদের মধ্যে আবু তালহা, মোহাম্মদ নুরুন্নবী, মেহেদি, রাহাজুল ও জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তাঁদের কারও কারও শরীর ৩০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে।
বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বললেন, ‘আজ এক তরুণ ছাত্র (ওহিদুর রহমান) মারা গেল। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছু হতে পারে না। অসহায় রোগীর পাশে আমরা চিকিৎসকেরাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ি।’ তিনি সুষ্ঠু চিকিৎসা ও সংক্রমণ এড়ানোর স্বার্থে রোগীর পাশে দর্শনার্থীদের ভিড় না করতে অনুরোধ করেন।
সন্ত্রাসীদের আগুনের পোড়া যন্ত্রণাকাতর মানুষের আর্তনাদ, উদ্বিগ্ন স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস, আর সন্তানহারা মায়ের আহাজারিতে গতকাল মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল বার্ন ইউনিটের পরিবেশ। এই কান্না, এই আর্তনাদে কি বোমাবাজদের বিবেক দংশন হবে না?