মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পঞ্চম কিস্তি
ভাষা আন্দোলন জোরদার করতে ছাত্রদের খেপিয়ে তুলেছিল কমিউনিস্টরা। এর আগে তারা ঘাপটি মেরে ছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট নাশকতাকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ এম মালিকের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হয়েছিল ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জন ডব্লিউ বাউলিং বায়ান্নর ১৪ মার্চের পূর্ববর্তী ৭ দিনের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ পাঠানো ওই বার্তায় তিনি লেখেন, গোটা সপ্তাহে কোথাও সহিংসতা ঘটেনি। গোটা প্রদেশজুড়ে অর্থনৈতিক জীবন ছিল স্বাভাবিক। ৪৫ জনের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশির ভাগই জেলা শহরগুলো থেকে। এর আগে গ্রেপ্তারকৃত প্রায় ৮৫ জন, যাঁদের অধিকাংশই ঢাকার ছাত্র, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর নেপথ্যে পূর্ববঙ্গ সরকারের কৌশলগত চাল রয়েছে। আর সেটা হলো নাশকতাকারী শক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির প্রতি বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সম্পূর্ণ অনুমোদন সাপেক্ষে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সাম্প্রতিক দাঙ্গার দায়ে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছে। তবে এর মধ্যে নাশকতাকারীদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
বাউলিং উল্লেখ করেন, নূরুল আমীন সরকারের কতিপয় মুখপাত্র তাঁদের কিছু ভাষণে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে চরম সহিংস আক্রমণ চালাচ্ছেন। আর নূরুল আমীন বলেছেন, অন্যান্য কাজ গুছিয়ে নিয়ে তিনি নিজেই কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারণায় অংশ নিতে শিগগিরই প্রদেশ সফরে নামবেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশতার অবশ্য বুদ্ধি করে তাঁর ঢাকা অবস্থানকালে এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন। কিন্তু অপর সঙ্গী বাঙালি মন্ত্রী এ এম মালিক জনগণের সামনে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন। এ পর্যায়ে মার্কিন কনসাল উল্লেখ করেন, মালিকের দেওয়া বিবৃতির একটি কৌতূহলোদ্দীপক অংশ এই বার্তার সঙ্গে পাঠানো হলো। তাঁর অভিমতের সঙ্গে মার্কিন কনস্যুলেটের সাধারণ মতৈক্য রয়েছে।
১৯৫২ সালের ১০ মার্চ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ এম মালিকের দেওয়া সেই বিবৃতিতে লেখা ছিল, ‘বর্তমান গোলযোগের বহু আগে আমি যখন প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলাম, তখন আমি জেনেছিলাম নাশকতাকারী চক্র এই প্রদেশে তৎপর রয়েছে। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন ছিল। তাদের কিংবা তাদের সংগঠনকে চিহ্নিত করার মতো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। সৌভাগ্যবশত এসব সংগঠন এখনো পর্যন্ত তাদের ক্যুদেতার (সহিংসতা অথবা অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন) পরিকল্পনা সফল করতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত নয়। তারা ভাষার প্রশ্নে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আমাদের জনগণের তরুণ অংশের স্বপ্ন কাজে লাগাতে চেয়েছিল। নাশকতাকারী সংগঠনগুলো সম্ভবত ভবিষ্যতে কোনো সুবিধা করতে পারবে না জেনে ভাষা আন্দোলনের আড়ালে অতি উত্তেজিত হয়ে তড়িঘড়ি নেমে পড়েছিল। তারা পরিস্থিতির ওপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবং আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ভাষা আন্দোলন পরিচালনায় নির্দেশনা দেয়। তারা ছাত্র ও তাদের সংগঠনগুলোকে আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক দুভাবেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সব নাশকতাকারী সংগঠন, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গ এবং যারা বর্তমান সরকারের চোখে চোখ রাখতে চায় না, তারা এককাতারে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ্যে আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। ট্রেন ও তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তাদের তৎপরতা রয়েছে। রাস্তায় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করা হয়েছে।
তারা সূক্ষ্ম এবং খুবই চাতুর্যপূর্ণভাবে সরকারের ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তারা যদি সফল হয়, তাহলে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে। সেই দাসত্ব কে জানে কত শতাব্দী ধরে চলবে। মালেক আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান এই বলে যে ভাষা আন্দোলনের ফলে ওই নাশকতাকারী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় তাদের চেনা যেত না।