আগামী বৃহস্পতিবার সারা দেশের সব ওষুধের দোকান বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি (বিসিডিএস)। দুই দিন পর গতকাল সোমবার মিটফোর্ডের ওষুধের দোকানগুলো খুললেও ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ করেছেন।
গত শনিবার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার নয়টি ওষুধের মার্কেটে ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুমতি ছাড়া আমদানি করা ওষুধ ও খাদ্য সম্পূরক বিক্রির অভিযোগে ১০৩ জনকে সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাঁদের মধ্যে ২০ জনকে এক বছর করে কারাদণ্ড এবং বাকি ৮৩ জনকে সোয়া কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় ২৮টি ওষুধের দোকান সিলগালা করে দেওয়া হয়। জব্দ করা হয় প্রচুর ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী।
এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল ওষুধ ব্যবসায়ীরা বৃহস্পতিবার ধর্মঘট ডেকেছেন। অন্যদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, কিছু অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীর হুমকি-ধমকিতে প্রশাসন অভিযান থেকে পিছু হটবে না।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে মিটফোর্ড সড়কে ওষুধ ব্যবসায়ীদের পূর্বনির্ধারিত মানববন্ধন কর্মসূচি সমাবেশে পরিণত হয়। সমাবেশ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ীদের মুক্তি, জব্দ করা ওষুধ ও সামগ্রীর ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং হয়রানির প্রতিকার দাবি করা হয়। একই সঙ্গে তাঁরা বিসিডিএসের ঢাকা শাখার নেতাদের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে ওই কমিটি বিলুপ্তির দাবি জানান। এ সময় বক্তব্য দেন বিসিডিএসের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদেকুর রহমান ও আলিফ-লাম-মিম মার্কেট সমিতির নেতা জাকির হোসেন। তবে ব্যবসায়ীরা এই দুই ব্যক্তির ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না। তাঁরা বারবারই হাত নেড়ে চিৎকার করে অনাস্থা জানাচ্ছিলেন।
পরে সাদেকুর রহমান ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়ার দায়িত্ব নিলে তাঁরা কিছুটা শান্ত হন। একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সারা দেশে ওষুধের দোকানে ধর্মঘট কর্মসূচিও ঘোষণা করেন তিনি। সাদেকুর বলেন, যেসব কোম্পানির মাল রাখার দায়ে ব্যবসায়ীদের দণ্ড ও জরিমানা এবং ওষুধ জব্দ হয়েছে, সেসব কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে।
সাদেকুর দাবি করেন, বিগত ২০ বছরে ঔষধ প্রশাসন কোনো গেজেট দেয়নি। এ কারণে কোনটি বিক্রি নিষিদ্ধ আর কোনটি ভেজাল, তা ব্যবসায়ীদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রচুর পরিমাণে সার্জিক্যাল আইটেম জব্দ করা হয়েছে। অথচ সার্জিক্যাল আইটেমকে যে ওষুধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তা অনেক ব্যবসায়ী জানতেনই না। বৃহস্পতিবারের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ীদের মুক্তি না দিলে এবং সরকার আলোচনায় না বসলে ওষুধের দোকানে টানা ধর্মঘটের হুমকি দেন তিনি। সমাবেশের পরে দুপুরে ওষুধের দোকানগুলো খোলা হয়।
তবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক বলেন, ‘যিনি যে পণ্যের ব্যবসা করেন তিনি সেটার ভলো-মন্দ চেনেন। আপনি ভুসির ব্যবসা করলে নিশ্চয়ই জানেন কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ।’ গতকাল সকালে এসব বিষয় নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন, সাংসদ এবং ফার্মাসিউটিক্যাল ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুকুমার রঞ্জন ঘোষ উপস্থিত ছিলেন।
মহাপরিচালক সন্ধিসুধা নামের একটি পণ্যের মোড়ক হাতে নিয়ে বলেন, গণমাধ্যমে প্রচুর বিজ্ঞাপন দিয়ে এই ধরনের অননুমোদিত পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এটা প্রতারণা। এগুলোর বিজ্ঞাপন ও বিক্রি বন্ধের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিকবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। পরামর্শমত্রে খাদ্য সম্পূরক না লেখার জন্য চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানান মহাপরিচালক।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান শুরুর পরে ব্যবসায়ীরা সবাই হুড়মুড় করে শাটার লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন মার্কেট ঘিরে প্রধান ফটক বন্ধ করে ক্রেতাদের বের করে দিয়ে ব্যবসায়ীদের বের হওয়া ঠেকানো হয়। কারণ, দোকান বন্ধ করে দিলে তো আর অভিযান হবে না।’ তিনি বলেন, কাউকে হয়রানি বা মালামাল লুট করার জন্য এ অভিযান চালানো হয়নি। তিনিসহ অনেক উচ্চপদের কর্মকর্তা অভিযান তদারকি করেছেন। তিনি আরও বলেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১১ মাসে ১১৯টি অভিযানে প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকা জরিমানা আদায় এবং ১২৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার পরে তারা হাইকোর্টে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে আবারও উৎপাদন করছে। তিনি বলেন, প্রতিটি ওষুধের দোকানে একজন করে ফার্মাসিস্ট থাকার শর্তেই ওষুধের দোকানের অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ সেখানে গিয়ে দেখা যায়, যাঁর নামে অনুমোদন তাঁর কোনো খোঁজই নেই। আরেকজন দোকান চালাচ্ছেন। ওষুধের দোকানে খাদ্য সম্পূরক, প্রসাধনী বা অন্য সামগ্রী বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকার পরও এগুলো বিক্রি হচ্ছিল।
বিসিডিএসের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদেকুর রহমান বলেন, যত দোকান আছে ততজন ফার্মাসিস্ট নেই। দোকানদারদের চার মাসের প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছিল। তবে মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি এখনো অনুমোদন পায়নি। সবকিছুই আটকে রয়েছে।
সাদেকুর রহমান পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ঔষধ প্রশাসন যদি তাদের কাজ নিয়মিত করত তাহলে বিষয়টি এত বড় হতো না।