ওরস্যালাইন যেভাবে কাজ করে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে, কেউ দৈনিক গড়ে যতবার মলত্যাগ করে (সাধারণত সংখ্যাটি ৩ তবে কমবেশি হতে পারে) তার চেয়ে বেশিসংখ্যক বার পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে। ডায়রিয়া নানা কারণে হতে পারে। সংক্রামক কারণগুলোর মধ্যে ভাইরাস (যেমন রোটাভাইরাস ইত্যাদি), ব্যাকটেরিয়া (যেমন কলেরা, শিগেলা, ই. কোলাই ইত্যাদি), পরজীবী (যেমন অ্যামিবা ইত্যাদি) এবং ছত্রাক প্রধান। অসংক্রামক কারণেও ডায়রিয়া হয়। তবে বাংলাদেশে সংক্রামক ডায়রিয়া (বিশেষত রোটাভাইরাস, কলেরা এবং ই. কোলাই জনিত) অনেক বেশি হারে দেখা যায়।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অন্ত্রে প্রতিদিন গড়ে সর্বোচ্চ ২০ লিটার পর্যন্ত পানি নিঃসরণ হয়ে থাকে। খাদ্য হজমের জন্য নানা প্রকার এনজাইম ও পাচক রস নিঃসরণ করতে এবং পরিপাক নালির মধ্য দিয়ে চলার সময় খাদ্যমণ্ডের ঘর্ষণ কমাতে এটুকু পানি প্রয়োজন। আবার পরিপাকতন্ত্র প্রতিদিন গড়ে নিঃসরণের প্রায় সমপরিমাণ পানি শোষণও করে। সব মিলিয়ে দেহে পানির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে। ডায়রিয়া যে কারণেই হোক না কেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা অন্ত্রে পানির নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় অথবা পানিশোষণ কমিয়ে দেয়। ফলে দেহে পানির পরিমাণ কমে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে দেহ হারাতে থাকে পানিতে দ্রবীভূত বিভিন্ন পদার্থ। সোডিয়াম আয়ন তার মধ্যে একটি, যা একটা নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে গেলে স্নায়ুতন্ত্র কাজ করতে পারে না। আর পানির অভাবে শরীরের প্রায় সব শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। পানি ও সোডিয়াম আয়নের মাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক না হলে কিডনি, মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করে। মৃত্যুও হতে পারে।
ডায়রিয়ার চিকিৎসা হিসেবে শুধু পানি খেলে লাভ হয় না। কারণ, এতে সোডিয়ামের ঘাটতি মেটে না। তাহলে লবণ-পানি খেলে সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা, যেহেতু খাওয়ার লবণ মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইড। কিন্তু তাতেও উপকার পাওয়া যায় না; বরং দেহ আরও পানিশূন্য হতে থাকে। একটা পাতলা দ্রবণ আর একটা গাঢ় দ্রবণের মধ্যে অর্ধভেদ্য পর্দা থাকলে দ্রাবক (যেমন: পানি) সেই পর্দা ভেদ করে পাতলা দ্রবণ থেকে গাঢ় দ্রবণে চলে আসতে থাকে। এর নাম অভিস্রবণ। জীবকোষ এক প্রকার অর্ধভেদ্য পর্দা। ডায়রিয়া হলে দেহে এমনিতেই সোডিয়াম কমে যায়। সেই অবস্থায় লবণ-পানি খেলে পৌষ্টিকনালির আবরণী কোষ থেকে আরও পানি বেরিয়ে চলে আসে। স্বাভাবিক অবস্থায় অন্ত্রের কোষঝিল্লিতে থাকা সোডিয়াম চ্যানেল দিয়ে এমনিতে যেটুকু সোডিয়াম আয়ন শোষিত হতে পারত, ডায়রিয়ার ফলে সেটুকুও হয় না। সব মিলিয়ে ডায়রিয়ার অবনতি ঘটে।
তখন হয় শিরাপথে সরাসরি রক্তে স্যালাইন দিতে হবে; নয়তো অন্ত্রের কোষঝিল্লিতে থাকা আরেকটি পথ, সোডিয়াম-গ্লুকোজ কোট্রান্সপোর্টার ব্যবহার করতে হবে। এর মাধ্যমে একটি গ্লুকোজ অণুর সঙ্গে একটি সোডিয়াম আয়ন একত্রে কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে। এভাবে একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন কোষের ভেতরে দ্রবের ঘনত্ব বেড়ে যায়, তখন অভিস্রবণের মাধ্যমে কোষের বাইরের পানি ভেতরে ঢুকতে থাকে এবং পানিশূন্যতা কমতে থাকে। গ্লুকোজ না থাকলে এই পদ্ধতি কাজ করে না। এখানে সোডিয়াম আয়ন ও গ্লুকোজের অণুর সংখ্যা সমান সমান হতে হবে। মুখে খাওয়ার স্যালাইনে খুব সূক্ষ্মভাবে এই হিসাব মেনে বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ পাউডার আকারে থাকে। সোডিয়াম আয়ন বা গ্লুকোজের কোনোটার অণুর সংখ্যা বেশ কম হয়ে গেলে বিপদ। এ জন্য খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেটে থাকা সবটুকু পাউডার একবারে নির্ধারিত পরিমাণ পানিতে মিশিয়ে নিতে হবে, ভেঙে ভেঙে মেশানো যাবে না। পানির পরিমাণের হেরফের হলেও একই সমস্যা হতে পারে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।