বিশেষ সাক্ষাৎকার : বদরুদ্দীন উমর
‘এমন আন্দোলন সমগ্র উপমহাদেশে হয়নি’
বদরুদ্দীন উমর লেখক-গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিপিই ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি এবং লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে ও রাফসান গালিব।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলনের ওপর যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা। সেদিক থেকে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ভিন্ন। এই বই লেখার তাগিদ কীভাবে পেলেন?
বদরুদ্দীন উমর: ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমিও স্মৃতিচারণা করেছি। আমার আত্মজীবনী আমার জীবন–এর দ্বিতীয় খণ্ডে ভাষা আন্দোলনের ওপর স্মৃতিচারণা করেছি। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি লেখার যে চিন্তা, সেটি হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে। পূর্ব পাকিস্তানের সমসাময়িক ইতিহাসের ওপরে কাজ করার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলাম, সাক্ষাৎকারও নিচ্ছিলাম। সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের ওপরও অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। আমি ভাবলাম, ভাষা আন্দোলনের ওপরে আলাদা করে ছোট একটি বই লিখব। ১০০ থেকে ১৫০, খুব জোর ২০০ পৃষ্ঠার একটি বই হবে। কিন্তু যতই আমি তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলাম এবং সাক্ষাৎকার নিতে থাকলাম; ততই দেখা গেল, এত বিপুলসংখ্যক তথ্য সেখানে পাওয়া যাচ্ছে যে খুব ছোট আকারের কাজের দ্বারা এটিকে ধারণ করা যাবে না। এ ছাড়া প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলনকে ছাত্রদের একটি আন্দোলন হিসেবে, মধ্যশ্রেণির শিক্ষিত লোকদের একটি আন্দোলন হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে। এখনে পর্যন্ত সেটি আছে। এখনো ভাষা আন্দোলনের ওপরে যাঁরা নানা রকমের বাক্যবিস্তার করেন, তাঁরা কিন্তু সেখানে একদমই কৃষক বা শ্রমিকের কথা বলেন না। যেসব তথ্য আমার হাতে আসছিল, তাতে দেখা গেল যে বিচ্ছিন্নভাবে এই আন্দোলনকে ছাত্র কিংবা মধ্যশ্রেণির আন্দোলন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল একটা মহাবিদ্রোহের মতো। কাজেই আমি তখন ভাবলাম, যে পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনটা হয়েছে, তার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে যদি আলোচনা করা হয়, তাহলে সেই আন্দোলন কখনো সঠিকভাবে বোঝা যাবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনার এ বইয়ের গবেষণাপদ্ধতি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। বইটি লিখতে কী পদ্ধতিতে আপনি এগিয়েছিলেন?
বদরুদ্দীন উমর: আমার এই বই সম্পর্কে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে মেথোডলজি। আমি যে পদ্ধতি এই বইয়ে ব্যবহার করেছি, সেটি আগে কেউ কোনো দিন এখানে ব্যবহার করেননি। সংবাদপত্রের তথ্য, নানা ধরনের বই (এ বিষয়ে বই খুব বেশি পায়নি), লিফলেট, সাক্ষাৎকার এ সবকিছুই আমি এখানে ব্যবহার করেছি। এর জন্য আমি বাংলাদেশের লাইব্রেরি ও কলকাতার লাইব্রেরিতে কাজ করেছি। এসব মিলে আমি নিজের একটি পদ্ধতি ঠিক করেছি বইটি লেখার জন্য।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনার বইটিতে ভাষা আন্দোলনকে বিশাল একটি পটভূমি থেকে দেখা হয়েছে। বলা চলে এটি পাকিস্তানের প্রথম কয়েক বছরের সামাজিক–রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। কেন এত বড় পটভূমিতে ভাষা আন্দোলনকে দেখলেন?
বদরুদ্দীন উমর: বইটি লিখতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছিলাম, এ আন্দোলনে কৃষকদের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কৃষকদের এই ভূমিকার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯৪৮ সালের আন্দোলন আর ১৯৫২ সালের আন্দোলনের মধ্যে একটি দুস্তর পার্থক্য ছিল। আটচল্লিশ সালে, এটা ঠিক যে ভাষা আন্দোলন মধ্যশ্রেণির ও ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আটচল্লিশ সালে যখন আন্দোলন করেছিল, তখন পুরান ঢাকার লোকেরা এত ক্ষিপ্ত ছিল যে রেললাইনের ওপাশে—মেডিকেল কলেজ থেকে নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে—গেলে তারা ছাত্রদের মারধর করত। অথচ বায়ান্ন সালে পুরান ঢাকার লোকেরাই আন্দোলনের বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে ২২ ফেব্রুয়ারি সেটি হয়েছিল। আমি পরে চিন্তা করলাম, এই পার্থক্য যেটি ঘটেছে, সেটি নিশ্চয়ই এই পর্যায়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ও মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন হয়েছে, সেই পরিবর্তনগুলোর কারণেই হয়েছে। তখন খাদ্যাভাবের একটি ভীষণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। খুলনা, বরিশাল, উত্তরবঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মানুষের খুবই কষ্ট ছিল। দুর্ভিক্ষের কারণেই তখনকার জনগণের পাকিস্তানের ব্যাপারে মোহমুক্তি ঘটেছিল। সে জন্য ১৯৪৯ সালে যে উপনির্বাচন হয়েছিল, তাতে মুসলিম লীগের প্রার্থী বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন তরুণ নেতা শামসুল হক। চারদিক থেকে লোকজন গিয়ে তাঁর নির্বাচন করে দিয়েছিল। নির্বাচনে তাঁর তেমন কোনো খরচ হয়নি। যেখানে মুসলিম লীগের সভা হতো, সেখানে লোকজন গিয়ে ঘেরাও করে সেটিকে শামসুল হকের সভায় পরিণত করত। এ পরিবর্তনকে আমলে না নিয়ে, বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি হলো আর দেশসুদ্ধ লোক আন্দোলন শুরু করল, এমন আলোচনা অর্থহীন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনার বইটির বড় অংশ কৃষক আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কৃষকদের আন্দোলনের যোগসূত্রটা কীভাবে হয়েছিল?
বদরুদ্দীন উমর: একুশে ফেব্রুয়ারি গুলির পর দেশময় আন্দোলন হয়েছিল, কৃষক এলাকাতেও আন্দোলন হয়েছিল। মোরেলগঞ্জ তখন খুলনার ছোট গ্রাম। তখন সেখানে খাদ্যাভাবের জন্য রিলিফের কাজ চলছিল। দিনমজুরদের সরকার খাদ্যের বিনিময়ে কাজ দিচ্ছিল। সেই দিনমজুরেরা ২২ তারিখে ধর্মঘট করলেন। এটা আপাতদৃষ্টে বিস্ময়কর ব্যাপার মনে হতে পারে। কিন্তু এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তখন এত খাদ্যাভাব হয়েছিল, লোকের এত দুরবস্থা হয়েছিল যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। এই না খাওয়া লোকেরা এক দিন কাজ না করতে পারলে তারা খেতে পারবে না, তাই তারা ওই দিন ধর্মঘট করেছিল। এসব দেখে আমার একটি ধারণা হলো, ভাষা আন্দোলন নিয়ে সামগ্রিকভাবে আলোচনা দরকার। সে জন্য আমি বইটিতে কৃষকদের ওপরে ব্যাপক আলোচনা করেছি। ভাষা আন্দোলনের মতো এমন আন্দোলন সমগ্র উপমহাদেশে হয়নি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনি কি তাহলে বলতে চাইছেন ভাষা আন্দোলনে মধ্যবিত্ত এবং কৃষক–শ্রমিকের অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট ও কারণ ভিন্ন ছিল। এ বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বদরুদ্দীন উমর: ভাষা জিনিসটা মধ্যবিত্তের চেয়ে কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য বেশি দরকার। কারণ, তারা বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না। মধ্যবিত্তরা তো ইংরেজি বা অন্য ভাষা জানতে পারে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে। ফলে ভাষার ওপর যে আক্রমণ, সেটি মধ্যবিত্তের চেয়েও কৃষক ও শ্রমিকের ওপর বড় আক্রমণ। কারণ, তার যে একমাত্র ভাষা, সেটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তার বিকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। মধ্যবিত্তের তো চলে যাওয়ার পথ আছে, কৃষক–শ্রমিকের তো সেই পথ নেই। একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য, অন্যদিকে যে ভাষায় তারা কথা বলে, সেটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাদের কাছে বার্তা গেল যে তারা যে ভাষায় কথা বলে, পাকিস্তান সরকার সেটি বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে এটি তো তার কাছে বড় প্রতিরোধের বিষয়। ফলে ভাষা আন্দোলন কৃষক–শ্রমিকদের পর্যন্ত চলে গেল। অর্থনৈতিক বৈষ্যমটাও সেখানে বড় ধরনের ভূমিকা রাখল।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এ ধরনের একটি গবেষণার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: আমি উদ্দেশ্য থেকে এ পর্যন্ত এক লাইনও লিখিনি। যে তত্ত্ব নির্মাণ করা দরকার বলে মনে হয়েছে, সেই তত্ত্বই আমি নির্মাণ করেছি। উদ্দেশ্য যদি বলেন, সেটি একটাই, কী করে এ দেশের মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন হবে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বই লেখার সময় সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমি লিখিনি। আমি লিখেছি, এই দেশের একটি মহৎ বিশাল আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করতে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনার বইটি ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথম গবেষণা। পরবর্তীকালের গবেষণাগুলোর মধ্যে কোনটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন?
বদরুদ্দীন উমর: বশীর আল্হেলালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বইটা উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো সেখানে বড় পরিসরে আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) থেকে আরেকটা কাজ হয়েছিল কয়েক খণ্ডে। সেটি একটি গবেষণামূলক কাজ, তবে এর একটি খণ্ড আমার বই থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমি তাদের বলেছিলাম বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেটি অনুসন্ধান করে বের করে আনেন। আপনাদের রিসোর্স, টাকাপয়সা ও লোকজন আছে। কিন্তু তারা সেটি করেনি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলন নিয়ে ভবিষ্যতে আর কোন কোন জায়গায় গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
বদরুদ্দীন উমর: ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক নানা রকম ব্যাখ্যা হতেই পারে। কী ব্যাখ্যা হবে, সেটি তো আমার বলার কথা নয়। যারা করবে কাজ, তাদের সেটি নির্ধারণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব, ক্রমওয়েল বিপ্লব কিংবা রুশ বিপ্লবের ওপর গবেষণা হচ্ছে। লেখালেখি হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের ওপরেও লেখা হতে থাকবে। আমি আমার বইটাতে প্রায় সব দিকই ধারণ করার চেষ্টা করেছি। তবে আমি সারা গ্রামাঞ্চলে বা শ্রমিকদের মধ্যে কী হয়েছে, সেটি তো বিস্তারিত তুলে আনতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আরও কাজ হতে পারে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বদরুদ্দীন উমর: প্রথমত, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়েছিল দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এবং ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব গুরুত্বপূর্ণ দুটি দ্বন্দ্ব। এ দুটি দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয়েছিল ভারত স্বাধীন হয়ে এবং দুই ভাগ হয়ে। সাতচল্লিশ সালে দেশ ভাগের পর দেখা গেল সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বটা মূল দ্বন্দ্ব থাকল না। সামনে চলে এল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের এ পরিবর্তনের ফলে রাজনীতিটাও পরিবর্তন হলো। রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকীকরণের একটি সূত্রপাত হলো। ভাষা আন্দোলনকে এ প্রেক্ষাপটেও দেখতে হবে। মধ্যবিত্তের যে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হলো, তাতে অর্থনৈতিক ব্যাপারের চেয়ে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক আক্রমণটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কৃষক–শ্রমিকের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শিক্ষার দিক থেকে আক্রমণ হলো। আরবি হরফ প্রচলন ও মুসলমানি বাংলা সৃষ্টির চেষ্টা হলো। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ এই কবিতাটি বদলে কবি গোলাম মোস্তফা লিখলেন, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি/ তামাম রোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি।’ এ ধরনের চরম বিকৃতি ও বীভৎস ব্যাপার শুরু হলো। এর প্রতিক্রিয়ায় এখানে একটি নতুন অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্মেষ হলো।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এটাকেই আপনি বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বলেছেন...
বদরুদ্দীন উমর: হ্যাঁ, বলা চলে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুরু হলো। মুসলমানরা মনে করত ইরান, আরব, তুরস্ক তাদের আসল জন্মভূমি। সবাই যে মনে করত, তা নয়। কিন্তু একটি প্রভাবশালী অংশ সেটি মনে করত। এ অংশের সামাজিক ভিত্তিভূমিটা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছিল আর ইতিবাচক পরিবর্তনটা দেখা দিচ্ছিল বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, স্বদেশ এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে। এ জন্য আমি বলেছিলাম, বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ভাষা আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলনকে আপনি জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন বলছেন। সেই আন্দোলন কি পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদের ছোট গণ্ডিতে ঢুকে গেল? এটাতে আমাদের কী ক্ষতি হলো?
বদরুদ্দীন উমর: ভাষা আন্দোলনের সময়টাতে এখানে একটি জাতীয় বিকাশ ঘটছিল। জাতীয় বিকাশ আর জাতীয়তাবাদ তো এক জিনিস নয়। এটি হচ্ছে একটি জাতির সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির বিকাশ। কিন্তু জাতীয়তাবাদে অপর থাকে। জাতীয় বিকাশ তো সবাইকে নিয়ে হয়, সেখানে কোনো অপর নেই। জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে এখানে কমিউনিস্টদের ব্যর্থতা আমরা দেখতে পাই। তারা কখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তাদের মধ্যে ত্যাগ ছিল, তিতিক্ষা ছিল, উদ্দেশ্য সৎ ও মহৎ ছিল, কিন্তু তাদের সঠিক চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল না। এখানে কমিউনিস্টরা জাতীয় বিকাশ ঘটছিল তার ধরনটাকেই বুঝতে পারেনি। এখানে তারা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলল। না তারা শ্রেণিসংগ্রাম করতে পারল, না তারা জাতীয় বিকাশের সংগ্রামে কোনো সহায়তা করতে পারল। ফলে গোটা জাতীয় জাগরণের আন্দোলনটা আওয়ামী লীগের মুঠোয় চলে গেল। এতে সমাজে যে গণতন্ত্রের চর্চা, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, সেটা উঠে গেল।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনি লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনের সত্যিকার নায়ক ছিল পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণ। আপনার বইটিও তাঁদের উৎসর্গ করেছেন। তাঁরা কি সত্যি সত্যি এই ভূখণ্ডের নায়ক হতে পেরেছেন?
বদরুদ্দীন উমর: না, পরবর্তী সময়ে তো নাটকের মতো নকল নায়কেরা ইতিহাসের আসল নায়ককে হত্যা করেছে। সে জন্য আসল নায়কের নাম কোথাও পাবেন না, নকল নায়কের নাম পাবেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
বদরুদ্দীন উমর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
ফেব্রুয়ারি ২০২২