আসুক বিজ্ঞানের দিন
১৯৯৫ সাল। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। সেবার আমাদের স্কুলে একটা বিজ্ঞান মেলা আয়োজন করা হয়েছিল। মা-বাবা বিজ্ঞানী বলেই হয়তো একটা দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। ঘরে ফিরে মা-বাবাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বললেন, শুধু একটা প্রকল্প প্রদর্শনী করলেই হবে না, চিন্তা করতে হবে প্রদর্শনীটা কীভাবে মেলার অতিথিদেরও কাজে লাগতে পারে। অর্থাৎ কীভাবে প্রকল্পটা জনগণের কাজে লাগবে। অনেক চিন্তাভাবনা করে আমরা পারিবারিকভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম—আমি ও আমার দল ‘ব্লাডগ্রুপিং’ নিয়ে প্রকল্প করব। সেই ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের খুব কম মানুষই জানত তাদের রক্তের গ্রুপ কী।
আমার দল আর আমি হাজির হয়ে গেলাম বাবার ল্যাবরেটরিতে। দেখলাম এবং শিখলাম কীভাবে রক্তের গ্রুপিং করা হয়। বিজ্ঞান মেলার দিন আমাদের প্রকল্পে যাঁরা ঘুরতে এসেছিলেন, উৎসাহী সবার রক্তের গ্রুপিং করে, নিজে স্বাক্ষর করে রিপোর্টও দিলাম সবাইকে। সেদিন বাসায় ফেরত এলাম প্রথম পুরস্কার নিয়ে। প্রবেশ করলাম বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের জগতে।
বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল থেকে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল সম্পন্ন করে চলে গেলাম সুদূর কানাডায়। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমেস্ট্রিতে ব্যাচেলর’স (আন্ডারগ্র্যাজুয়েট) করলাম। সেটা ২০০৯ সালের কথা। তারপর ২০১৬ সালে সেখান থেকেই পিএইচডি শেষ করলাম মলিক্যুলার জেনেটিকসে। এরপর খুব ভালো একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম কানাডার সবচেয়ে বড় শিশু হাসপাতাল—হসপিটাল অব চিলড্রেনে। কিন্তু আমার মন একেবারেই বসছিল না। চিন্তা করতাম, আমি যে এত কাজ করছি বা শিখছি তাতে কী লাভ হচ্ছে? আমার কাজ জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি?
মাত্র চার মাস পরে, কানাডার ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম বাংলাদেশে। যোগ দিলাম চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ)। এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেনিনজাইটিস নিয়ে কাজ করা।
মেনিনজাইটিস একধরনের ব্রেন ইনফেকশন। বাংলাদেশে অনেক শিশুর মেনিনজাইটিস হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই মারা যায়। আর যারা বেঁচে থাকে তাদের মধ্যে অনেককেই বেঁচে থাকতে হয় প্রতিবন্ধী হয়ে। আমাদের দেশে একটা নিম্ন আয়ের পরিবারের যখন কোনো শিশু প্রতিবন্ধী হয়, তখন শুধু শিশু নয় পুরো পরিবারটিই যেন প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ওই পরিবারের ভাই-বোন স্কুলে যেতে পারে না, হয়তো মাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। বাবাকে সব সম্পত্তি বন্ধক দিতে হয় অথবা বিক্রি করে দিতে হয় ।
মেনিনজাইটিস কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলতে পারে। তাই ভালো চিকিৎসা থেকেও দরকার এই রোগের প্রতিরোধ। আর এর জন্য প্রয়োজন কোনো কার্যকর টিকা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বেশির ভাগ মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রেই আমরা জানি না যে কোন কোন জীবাণু দিয়ে এই জটিল রোগ হয়। ফলে আমরা বুঝব কীভাবে কোন টিকা কার্যকর হবে! সেটা বোঝার জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশে একটি অত্যাধুনিক আরএনএ মেটাজিনোমিক সিকুয়েন্সিং ল্যাবরেটরি। কিন্তু তা তো নেই এ দেশে! তাই ভাবলাম, এখানে একটা অত্যাধুনিক আরএনএ মেটাজিনোমিক সিকুয়েন্সিং গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করব। সেটা ২০১৬ সালের কথা।
আমার জন্য এর পরের দুই বছর ছিল ব্যর্থতায় ভরা। কোনো গ্র্যান্ট নেই, টাকাপয়সা নেই। ছোট ছোট কিছু প্রকল্পে কাজ করলাম। পাশাপাশি করলাম অনেক পড়াশোনা, যোগাযোগ করলাম আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সঙ্গেও। অবশেষে ২০১৮ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল চান-জাকার্বাগ বায়োহাবের সঙ্গে। আর সেখানে আমার বন্ধুত্ব হলো প্রফেসর জোসেফ দিরিসির সঙ্গেও।
এরপর আমি চলে গেলাম যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে। আরএনএ মেটাজিনোমিকস শিখলাম। সে জন্য ব্যবহার করলাম বাংলাদেশের কিছু নমুনা। এই কাজের মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত হলো চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের কারণে মেনিনজাইটিস হয়।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে একটি বড় মেনিনজাইটিস প্রাদুর্ভাব হয়েছিল এই ভাইরাসের আক্রমণে। বৈজ্ঞানিক সমাজে হইচই পড়ে গেল। আমরা গবেষণাপত্র প্রকাশ করলাম। দ্য আটলান্টিক-এর এড ইয়ং আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। সেটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎকার।
পরে শুরু হলো দ্বিতীয় ধাপ। মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে আমরা পেলাম সিকুয়েন্সিং মেশিন। সিকুয়েন্স করলাম ডেঙ্গু ভাইরাস, ফ্লু ভাইরাস ছাড়াও আরও কয়েক ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার।
কিন্তু কোভিড-১৯ যখন হানা দিল তখন মনে হলো আগের কাজগুলো যেন শুধুই ছিল অনুশীলন।
৮ মার্চ ২০২০। সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সারা দিন মাঠকর্মীদের সঙ্গে আনন্দ-হইচইয়ের পর ঢাকায় ফেরার সময় রেডিওতে শুনলাম, বাংলাদেশের প্রথম তিনজন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে। তারপর ২৯ মার্চ থেকে আমরা কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা শুরু করলাম।
কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারলাম, আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছে টিকা উদ্ভাবনের। বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও শুরু হতে যাচ্ছে। ভাবলাম, আমাদের দেশের ভাইরাসগুলো নিয়েও গবেষণা দরকার। মানুষকে জানানো দরকার, বাংলাদেশের ভাইরাসগুলো কেমন। যাঁরা টিকা বানাচ্ছেন, তাঁদের কাছে এই ডেটা বা তথ্যগুলোও পৌঁছানো দরকার। এসব সাতপাঁচ ভাবনা থেকেই শুরু করলাম, কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ের কাজ।
বাংলাদেশে আমরা প্রথম সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিং করলাম। দিনটা ছিল ২০২০ সালের ১১ মে। সাড়া পড়ে গেল গোটা দেশে। শুধু বিজ্ঞানীদের মধ্যেই নয়, সাধারণ জনগণও অসাধারণভাবে সাড়া দিলেন। হঠাৎ যেন বিজ্ঞানীরাই তারকা হয়ে উঠলেন। কিন্তু আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয়টা ছিল, আমরা এত দিন সিকুয়েন্সিংয়ের যে কাজ করেছি, তা এই প্রথম সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। এর যে কী আনন্দ, লিখে বোঝানো যাবে না। সেদিন আমি যেন ফিরে গিয়েছিলাম আমার সেই তৃতীয় শ্রেণির বিজ্ঞান মেলায়!
এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল আরও অনেকগুলো দল। এখন বাংলাদেশে ১৯-২০টি দল সিকুয়েন্সিং করে। সিকুয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে যেসব তথ্য-উপাত্ত তৈরি হচ্ছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য আমরা একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম বানিয়েছি। এর মাধ্যমে দেশ ও দেশের বাইরের সাধারণ মানুষ, গবেষক—সবাই দেখতে পারবেন আমাদের দেশের সার্স-কোভ-২-এর বৈশিষ্ট্য।
চলতি বছরের অক্টোবরে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। আশা করি, আস্তে আস্তে আরও কমবে। কোভিড-১৯ পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে সবার মনোযোগ কেড়েছে। দেখা গেছে অনেক আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। কিন্তু আমাদের দেশে কোভিড-১৯-এর বিপরীতে রয়েছে অনেক রোগ, যেগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে বা হচ্ছে বললেই চলে। এসব রোগকে বলা হয় ‘নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ’ বা উপেক্ষিত আঞ্চলিক রোগ। আমাদের এখন এই রোগগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। তাই আমরা তৈরি করছি একটি জিনোমিক অবজারভেটরি। সেখানে সব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সিকুয়েন্সিং এবং এদের বৈশিষ্ট্যগুলো নথিভুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে গতানুগতিক ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে যেসব রোগের জীবাণু নির্ধারণ করা যায় না, সেগুলোর আরএনএ মেটাজিনমিক সিকুয়েন্সিং করছি আমরা। আমাদের স্বপ্ন, একটি জীবাণুর অ্যাটলাস বানাব, যেখানে থাকবে দেশের শিশুদের রোগের জন্য দায়ী সব জীবাণুর বৈশিষ্ট্য। এই অ্যাটলাস ব্যবহার করে এখানকার নীতিনির্ধারক ও চিকিৎসক-সমাজ তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।
আমরা আরও স্বপ্ন দেখি, গবেষণাগারটি আরও বড় হবে, দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা কাজের সুযোগ পাবেন এখানে। সম্প্রতি আমরা গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে দুটি জমি পেয়েছি। সেখানে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার ও হাসপাতাল নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছি। এখন আমাদের ছোট আকাঙ্ক্ষাগুলো আরও বড় স্বপ্নের নৌকা হয়ে দুলছে। সেই জোরে এ কথাও বলতে ইচ্ছা করছে: যে গবেষণাগার ও হাসপাতাল আমরা তৈরি করছি, সেখানে কেবল অত্যাধুনিক চিকিৎসা আর গবেষণাই হবে না, বরং আমার চেয়ে উদ্ভাবনীসম্পন্ন অনেক সেঁজুতির ভিড়ে আমাকে হয়তো সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না, খোঁজার দরকারও হবে না। আসুক বিজ্ঞানের দিন। সেই দিনের প্রত্যাশায় আমি চোখ পেতে আছি।
সেঁজুতি সাহা: অণুজীববিজ্ঞানী, কোভিড-১৯-এর জিনোম সিকুয়েন্সিং দলের প্রধান; চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের পরিচালক