আমাদের প্রাণের পতাকা
মনে আছে, সেই ১৯৭২ সালে বা তারও আগে, দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। যেদিকে তাকাই, দেখি বাংলাদেশের নতুন পতাকা; পত পত করে উড়ছে উন্মুক্ত নীল আকাশে। সবুজের মধ্যে লাল, লালের মাঝখানে সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র। আহা কী সুন্দর নিজের দেশের একটা পতাকা! কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মাঝখানের ওই মানচিত্রটা ঠিকভাবে আঁকা নিয়ে। আমি ভূগোলের ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি। আমি তো জানি ফ্রি হ্যান্ডে একটা দেশের মানচিত্র আঁকা কত কঠিন। আর যারা পতাকা সেলাই করে বানায়, তাদের কথাটা একবার ভাবুন, তারা কি পতাকায় দেশের মানচিত্রটা ঠিকভাবে আনতে পারবে?
মনে আছে, সেই সময়ই পিরোজপুর শহর থেকে আমার শহীদ বাবার প্রথম কবরটি দেখতে আমরা মা আর ভাইবোনেরা বেরিয়েছি নৌকায় করে। বলেশ্বর নদ দিয়ে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখি আশপাশে সব নৌকায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। সবুজের মধ্যে গোল লাল ঠিক আছে, তার মাঝখানে যত গন্ডগোল বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে। ম্যাপ হয়ে গেছে যেন রাশিয়ার নাকি ইউক্রেনের? এখন যুদ্ধ চলছে বলেই এই দুটো দেশের নামই লিখতে গিয়ে মাথায় এল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম কেউ কেউ ম্যাপ আঁকার ঝামেলায় না গিয়ে মাছ বানিয়ে রেখেছে, লাল সূর্যের মধ্যে হলুদ রঙের মাছ। সোনালি রং কোথায় পাবে, তার চেয়ে সহজ কাছাকাছি হলুদ রঙে কিছু একটা বসিয়ে দেওয়া লালের মাঝখানে।
এসব কারণেই বোধ হয় পরে লালের মাঝখানে দেশের মানচিত্রের ধারণাটি বাদ দেওয়া হলো। এখন আমাদের পতাকা গাঢ় সবুজের মাঝখানে টকটকে লাল একটা সূর্য। যার দিকে গভীরভাবে তাকালে চোখে পানি চলে আসে। আহা, ৩০ লাখ শহীদের রক্তরঞ্জিত আমাদের প্রাণের পতাকা।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমরা কি এখনো সঠিক রঙে পতাকা পাচ্ছি? মানে সবুজের সঠিক মাত্রা বা লালের সঠিক টেক্সচার দিয়ে বানানো একদম ১০০ শতাংশ সঠিক একটা পতাকা। মনে আছে, ওই কাছাকাছি সময়ে আবার সবাই পিরোজপুরেই একবার কী কারণে যেন গিয়েছিলাম। যথারীতি নৌকা করেই। তখনো সব নৌকার ওপরই পত পত করে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। সবুজের মধ্যে লাল। অবশ্য সবুজ রংটা সব জায়গায় ঠিক নেই। কিন্তু হঠাৎ করে দেখি কয়েকটা মাছ ধরার নৌকার ওপরে জাপানের পতাকা উড়ছে। মানে কি (সাদার মধ্যে লাল বৃত্ত নাকি আমাদের মতো সূর্য)? আমি পাশে বসা বড় ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, ‘দেখো ওরা জাপানের পতাকা লাগিয়েছে কেন?’ বড় ভাই হেসে ফেলল।
—আরে বোকা, ওটা বাংলাদেশের পতাকাই ছিল। রোদে–জলে সবুজ রংটা মুছে গিয়ে সাদা হয়ে গেছে।
কাজেই পতাকার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার। সেই জেলেনৌকার মাঝি হয়তো তখনো বুঝে উঠতে পারেনি তার নৌকার বাংলাদেশের পতাকা জাপানের পতাকা হয়ে গেছে। সে হয়তো জানেও না জাপানের পতাকা দেখতে কেমন। সে আবেগেই দেশের লাল–সবুজ পতাকা লাগিয়েছিল। কিন্তু রোদ যে বিশ্বঘাতকতা করবে, তা কি জানত সে! কাজেই পতাকার কাপড়ের ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে আমাদের। আর কাপড় হতে হবে সে রকম, যার রং কখনো উঠবে না। কি সবুজ, কি লাল। লাল রং তো ওঠাই যাবে না, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত মুছে ফেলা এত সহজ?
হ্যাঁ, এখনই সময় সঠিক রঙে সঠিক মাপে আমাদের প্রাণের পতাকাটা হোক। স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি সঠিক পতাকা আমাদের
স্বাধীন উন্মুক্ত আকাশে উড়বে, এটা তো আমরা চাইতেই পারি।
আহসান হাবীব, কার্টুনিস্ট ও লেখক