আবাসনসংকট প্রকট

বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ফটক l প্রথম আলো
বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ফটক l প্রথম আলো

কলেজটি মেয়েদের। মোট ছাত্রী ৮ হাজার ৬০০। তাঁদের মধ্যে ৫ হাজারের বেশি ছাত্রী ঢাকার বাইরে থেকে আসা। কিন্তু থাকার জন্য আছে মাত্র ৪০০ আসনের দুটি ছাত্রীনিবাস। তা–ও কেবল স্নাতক পর্যন্ত থাকা যায়। স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রীদের জন্য আবাসনের সুবিধা নেই।
এটি রাজধানীর বকশীবাজারে অবস্থিত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের খণ্ডিত চিত্র। আবাসনসংকট ছাড়াও পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা, উচ্চমাধ্যমিকে খারাপ ফল হওয়াসহ আছে আরও নানা সমস্যা। তবে বেশির ভাগ সরকারি কলেজে স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকলেও এখানে তা আছে। সম্প্রতি কলেজে গিয়ে শিক্ষক, ছাত্রী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
১৯৪০ সালে এই কলেজটি ইডেন স্কুল ও কলেজ নামে স্থাপিত হয়। একাধিকবার নাম পরিবর্তন হয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম বদরুন্নেসার নামে কলেজটি হয়। কলেজটির অনেক ছাত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী।
২ দশমিক ১৫ একর জায়গায় অবস্থিত এই কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ২০টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৭টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়। এ ছাড়া আছে স্নাতক (পাস কোর্স) ও প্রিলিমিনারি কোর্স।
কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন ও পুরোনো নামে দুটি ছাত্রীনিবাসে প্রায় ৪০০ আসন থাকলেও থাকেন প্রায় ৮০০ ছাত্রী। প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক সাবিনা ইয়াসমিন ছাত্রীনিবাসের ছবি তুলতে হলে গিয়ে দেখেছেন, প্রায় প্রতিটি কক্ষেই একজনের বিছানায় দুজন করে থাকেন।
নতুন ছাত্রীনিবাসে থাকেন স্নাতকের ছাত্রী বৈশাখী বণিক। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ছাত্রী থাকায় কয়েক ধরনের সমস্যা হয়। গোসল ও বাথরুমের জন্য লাইন ধরতে হয়। প্রায় সময়ই পানির সমস্যা তো আছেই। খাবারের মানও খুব ভালো না। এ ছাড়া চারজনের কক্ষে আটজন থাকায় পড়তেও সমস্যা হয়।
মারুফা আক্তার নামে উচ্চমাধ্যমিকের এক ছাত্রী বলে, তারা নতুন ছাত্রীনিবাসের পাঁচতলায় চারজনের কক্ষে থাকে আটজন।
সম্প্রতি স্নাতক শেষ করা মনোবিজ্ঞানের এক ছাত্রী বললেন, তিনি স্নাতক পর্যন্ত ছাত্রীনিবাসে থাকলেও এখন থাকেন আজিমপুরে। কারণ স্নাতকের পর আর ছাত্রীনিবাসে থাকতে দেওয়া হয় না।
কয়েকজন শিক্ষক বলেন, থাকার জন্য প্রচুর আবেদন জমা পড়লেও সবাইকে থাকতে দেওয়া সম্ভব হয় না।
গত ২৮ ডিসেম্বর কলেজের বিষয়ে কথা হয় অধ্যক্ষ মাহবুবা রহমানের সঙ্গে। মেয়েদের আবাসিক সমস্যাই এখন বড় সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমিত আসনের ছাত্রীনিবাসে এত ছাত্রী থাকায় কক্ষগুলোতে ঠিকমতো পড়ার পরিবেশ থাকে না। অনেকে বারান্দায় বসেও পড়ে। তবে এই সমস্যা নিরসনের জন্য কয়েক দিন আগে তিনি বেসরকারি সহায়তায় ছাত্রীনিবাসের ছাদে একটি পাঠকক্ষ তৈরি করেছেন।
জানা গেছে, ছাত্রীনিবাস হলেও তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকের জন্য থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। অধ্যক্ষের জন্যও বাসভবন নেই। কার্যত সব আমলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেত্রীরা হল নিয়ন্ত্রণ করেন।
আবাসনসংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে যাতায়াতের সমস্যা। কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ছাত্রী জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে যাতায়াত কনে। কিন্তু ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য দুটি বাস থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে অনেক কষ্টে তাঁদের যাতায়াত করতে হয়।
প্রভাষকের ১৮ পদ শূন্য: কলেজে শিক্ষকের পদ আছে ১২৪টি। এর মধ্যে প্রভাষকের ৫২টি পদের মধ্যে ১৮টি শূন্য। অবশ্য সংযুক্তি মিলিয়ে মোট শিক্ষক আছেন ১৩৪ জন (প্রদর্শক বাদে)। এই হিসাবে ছাত্রী ও শিক্ষকের অনুপাত ১: ৬৪। শিক্ষকেরা বলছেন, দিন দিন ছাত্রী বাড়ছে। এ জন্য দ্রুত শিক্ষকের পদ বাড়ানো দরকার। ১৯৮৩ সালে করা প্রশাসনিক সংস্কার-সংক্রান্ত এনাম কমিটির সুপারিশ ছিল স্নাতকের (সম্মান) বিষয়গুলোর প্রতিটির জন্য কমপক্ষে ৮ জন ও স্নাতকোত্তরের ক্ষেত্রে প্রতিটির জন্য ১২ জন শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু এই কলেজে বাংলা, ইংরেজি ও অর্থনীতি ছাড়া কোনো বিভাগেই পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, ইসলামের শিক্ষা ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপকের কোনো পদ নেই। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে নিজস্ব কোনো শিক্ষক নেই।
উচ্চমাধ্যমিকে খারাপ ফল: ২০১৫ সালে এইচএসসিতে ১ হাজার ২১৪ জন ছাত্রী পরীক্ষা দিলেও জিপিএ-৫ পান মাত্র ৯ জন। ওই বছর অনুত্তীর্ণ হয় ২৪৫ জন। চলতি বছর জিপিএ-৫ বেড়ে ৬৭ জন হলেও ৬২ জনই বিজ্ঞানের। ৫ জন ব্যবসায় শিক্ষা শাখার। মানবিকে একজনও জিপিএ-৫ পাননি। এ বছর ১৯৪ জন পাস করতে পারেনি।
অধ্যক্ষ বলেন, অন্যান্য নামী কলেজে এসএসসিতে জিপিএ-৫-এর নিচে ভর্তি করা হয় না। কিন্তু এই কলেজে কম গ্রেড পাওয়া ছাত্রীদের ভর্তি করতে হয়। তিনি যোগ দেওয়ার পর উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রীদের দেখভালের জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করে কাজ করছেন।
উপস্থিতি কম: কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে উপস্থিতি বেশি হলেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে কম। পরীক্ষার জন্য ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক থাকলেও সেটি মানা হয় না।
স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া সুলতানা বলেন, তাঁদের ক্লাসে গড়ে উপস্থিতি ৫০ শতাংশের বেশি হয় না। তবে শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে চান।
অবশ্য এত সমস্যার মধ্যে এই কলেজে স্বাস্থ্য ও পরিষেবা কেন্দ্র আছে। কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধা কর্নারও আছে।
অধ্যক্ষ মাহবুবা রহমান বলেন, জায়গার অভাবে আবাসিক হলসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য কলেজের উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থিত সরকারি পরিত্যক্ত জায়গা বরাদ্দ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে অবকাঠামোগত সমস্যার অনেকটাই দূর করা সম্ভব হতো।