আজ অমর একুশে : স্মৃতিতে ২১—৫
আন্দোলনের প্রচারপত্র, আন্দোলনের প্রকাশনা
মাতৃভাষার দাবিতে বায়ান্নয় রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাঙালি। সে সময়ে যাঁরা যুক্ত ছিলেন সেই আন্দোলনে, তাঁদের নিজ চোখে দেখা ঘটনা।
একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (মধুর দোকানের সামনে) সভা হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। সেখানে ছাত্রদের চাপে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ছাত্রদের জঙ্গি মনোভাব ছিল। ভাইস চ্যান্সেলরও ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। ১০ জন করে একেক গ্রুপে কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বেলা একটা-সোয়া একটার দিকে অলি আহাদ আমাকে বললেন, ‘মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সামনে যে গেট, সেখানে ছাত্ররা পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছে। সেখানে গিয়ে ছাত্রদের ঢিল ছোড়া বন্ধ করুন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের খবর আছে, পুলিশ হয়তো আজকে গুলিও করতে পারে।’ আমি দেড়টার দিকে সেখানে যাই।
কলেজের গেটে আমি দেড়টার দিকে পৌঁছে দেখি ছেলেরা ঢিল ছুড়ছে এবং আমার যত দূর মনে হয়, সেখানে আমার পৌঁছানোর মিনিট পনেরো পরই গুলিটা হয়। প্রথম ব্যারাকে বরকত ছিলেন বোধ হয় ঘরের ভেতরে—বাঁশের বেড়া ভেদ করে গুলি তাঁকে আঘাত করে। এ ছাড়া বাইরের লোকও আঘাত পায়। গুলি হলে ছেলেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমি, আমীর আলী আর একজন আমার সঙ্গে ছিল—আমরা তিনজন মধুর ক্যানটিনে ফিরে আসি এবং জেলখানার উল্টো দিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যাই। সেখানে বসে একটা লিফলেট (প্রচারপত্র) লিখি। এ সময় আমি স্বেচ্ছায় ও লিফলেট লেখার কথা চিন্তা করে প্রেসে যাই। সেখানে ঘণ্টা দু-তিনেকের মধ্যে প্রুফ দেখে লিফলেটটি ছাপিয়ে আনি। এর হেডলাইন ছিল—‘মন্ত্রী মফিজউদ্দিন-এর আদেশে গুলি’। লিফলেট ১১৬ সাইজ ছিল। প্রেসটি সেদিন আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল।
চারটা-সাড়ে চারটার দিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। লিফলেট প্রায় দুই-তিন হাজার ছিল। চকবাজার, নাজিরাবাজার ও বিভিন্ন দিকে লিফলেটগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। উৎসাহী ছাত্ররাই এ লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে আসে। আমাদের এ আন্দোলন পরিচালনার প্রধান ঘাঁটি ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সারা দিন-রাত ধরে মাইকে বক্তৃতা হতো। এ মাইকে পুলিশের গুলি চালানো থেকে শুরু করে কী কী কর্মব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে জনগণকে জানিয়ে দেওয়া হতো। ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি আমার হাতে পার্টির একটি লিফলেট আসে ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য। এ লিফলেট ছাপি সাতরওজার কাছে একটি প্রেস থেকে। আমার ছোট ভাই চাদরে ঢেকে সে লিফলেটগুলো পৌঁছে দেয় এসএম হলের সামনে। এ লিফলেট নিয়ে আমি হলে যাই। ২২ ফেব্রুয়ারি বিরাট মিছিল বের হয়, তাতে আমরা অংশ নিই। মিছিল আবদুল গনি রোড ধরে গুলিস্তানের দিকে এগোতে থাকলে মিছিলের মাঝামাঝি অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। আমরাও তখন ঠিক সেখানেই ছিলাম। এরপর আমরা কিছু লোক কার্জন হলের বড় গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সেখানে দেখি, কার্জন হলের গেটের চারপাশে পুলিশ বা আর্মি আজ আর আমার ঠিক মনে নেই, পজিশন নিয়ে ছিল। আমি এবং আমার সঙ্গে তোফাজ্জল হোসেন কার্জন হল ঘুরে ঘুরে নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে চলে যাই। আমরা দেখলাম ফজলুল হক হল, এসএম হল এবং সেক্রেটারিয়েটের দিকে অসংখ্য পুলিশ বা আর্মি বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দেখে আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ঢালওয়ালা পুলিশ এসে মিছিল দুভাগে ভেঙে দেয়। মিছিলের একটি অংশ নাজিরাবাজারের দিকে, আরেকটি হাইকোর্টের দিকে চলে যায়। পরে মিছিলটি একত্র হয়েছিল। কিন্তু আমি এরপর মিছিলের সঙ্গে আর যেতে পারিনি। ২২ ফেব্রুয়ারিও কয়েকবার গুলি চলেছিল।
২১ তারিখে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমি শুধু বরকতকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। তখন আমরা একুশের পুরো খবর পাইনি, কিন্তু কিছু লাশ গুম হয়েছিল বলে শোনা গেছে। কিছু লোককে শনাক্ত করা হয়েছিল, কিছু লোককে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সালাম, বরকত, রফিক—এঁদের নাম পাওয়া গেছে। কিন্তু বাজারে জোর গুজব ছিল, ৫০-৬০ জন লোক মারা গেছে। সে সময় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন থাকলেও বাংলা ভাষার প্রশ্নে কোনো সংগঠনই দ্বিমত পোষণ করেনি। উত্তেজনা তুমুল ছিল এবং ছাত্রদের জঙ্গি মনোভাব ছিল।...
১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের ইলেকশন পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের জোয়ার খুব তীব্র ছিল। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমি একটা সংকলন বের করি ১৯৫৩ সালের মার্চে। ২১ দিন পর মুসলিম লীগ সরকার সংকলনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতিটি সভায় এ সংকলনটির ওপর থেকে সরকারি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
‘বায়ান্নর ভাষার লড়াই’ থেকে সংক্ষেপিত (একুশের পটভূমি, একুশের স্মৃতি, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)
হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-৮৩)
প্রয়াত কবি; একুশের সংকলন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র–এর সম্পাদক।