এক দশকের বেশি সময় ধরে বেতনের উচ্চতর ধাপে যেতে না পেরে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন ১ হাজার ১৩ জন চিকিৎসক। আদালত রায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বলেন, তাঁদের সেই সুযোগ-সুবিধা দিতে। মন্ত্রণালয়ের আপিল টেকেনি, কিন্তু চিকিৎসকদের ফাইলটিও নড়েনি।
২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ওই রায়ের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে তাঁদের নাম প্রকাশিত হয়। অধিদপ্তর জরুরি ভিত্তিতে একটি ছকে প্রত্যেকের সম্পর্কে তথ্য চায়। তাঁরা তড়িঘড়ি করে সেই ছক পূরণ করে জমা দেন। ওই পর্যন্তই। একজন চিকিৎসক শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেন।
একজন চিকিৎসক তিনভাবে চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারেন—বিসিএস দিয়ে, অস্থায়ী ভিত্তিতে অথবা প্রকল্পের মাধ্যমে। মন্ত্রণালয় পরে তাঁর চাকরি স্থায়ী করে। তিন ক্ষেত্রেই তিনি নবম গ্রেডে ঢোকেন। তিন বছর পর সপ্তম, এর দুই বছর পর ষষ্ঠ গ্রেডে ওঠেন।
তবে চাকরিকাল সন্তোষজনক ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আর চাকরির বয়স ১০ পেরোলে পঞ্চম গ্রেড তাঁর প্রাপ্য হয়। সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতিও হয়।
ওপরে বলা মামলাটি করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। সে সময়কার চাকরির শর্তাবলি-সংক্রান্ত আইনটি লোপ পেয়ে নতুন আইন হয়েছে। তবে এই বিধিগুলো মোটামুটি এক।
মামলাজয়ী অন্তত ৫০ জন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা কেউ নবম, কেউবা সপ্তম গ্রেডে আছেন। কারও কারও চাকরির বয়স এত দিনে দুই দশক ছাড়িয়েছে। তাঁরা বলেছেন, সবারই এই দশা।
চিকিৎসকদের বছরের পর বছর ধরে উচ্চতর বেতন স্কেল ও পদোন্নতিবঞ্চনার পরিস্থিতি প্রায় সর্বজনীন। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা আরও চারটি রিট মামলা করেছেন। আর চিকিৎসকেরা বলছেন, রিট হয়েছে সাতটি। সব কটিতেই রায় চিকিৎসকদের পক্ষে যায়।
প্রথম রিটটি হয়েছিল ২০১১ সালে। চিকিৎসকেরা বলছেন, সে ক্ষেত্রে আবেদনকারীরা প্রতিবিধান পেয়েছিলেন। তবে সরকার ও চিকিৎসকদের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আর প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই রায় কার্যকর করা হয়নি।
আইন অনুযায়ী, ক্যাডারভেদে বেতনের উচ্চতর গ্রেড ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় করার সুযোগ নেই। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে সেই বৈষম্য হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্য ক্যাডারের কোনো কোনো কর্মকর্তা সুবিধাটা পাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই বঞ্চিত থাকছেন। একই গ্রেডে এবং স্কেলের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও সুবিধার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করার সুযোগ নেই।
চিকিৎসক রেজওয়ানুর রহমান বিসিএস পাস করে কাজে যোগ দেন ২০০৩ সালের ৪ নভেম্বর। পরে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এবং মন্ত্রণালয় তাঁর চাকরি স্থায়ী করে। প্রারম্ভিক নবম থেকে সপ্তম গ্রেডে উঠতে ২০০৯ সাল হয়ে যায়।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কর্মরত এ চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আজও সপ্তম গ্রেডেই পড়ে আছেন। আদালতের রায় অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে তাঁর পঞ্চম গ্রেড পাওয়ার কথা ছিল। রেজওয়ানুর বলেন, ‘কেন আমাকে এভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তরও দেননি কেউ।’
কিন্তু আদালতের আদেশের পরও মন্ত্রণালয় কেন উচ্চতর গ্রেড বা পদোন্নতি দিচ্ছে না? স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, সরকারি চাকরির বিধিবিধান মেনেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। আর আদালতের নির্দেশ থাকলে তো দেওয়ারই কথা। অধিদপ্তর কাগজপত্র চেয়ে থাকলে অগ্রগতিও হওয়ার কথা।
তবে প্রথম আলোকে মন্ত্রী বলেন, রায়ে কী বলা আছে, তা তাঁকে জানতে হবে। দাবিদারদের সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাসের প্রশ্ন আছে। পদোন্নতি দিতে গিয়ে আইনের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ হচ্ছে কি না, সেটাও তিনি খতিয়ে দেখবেন।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আদালত বলেছেন দাবিদারদের প্রাপ্যতা সাপেক্ষে পদোন্নতি দিতে। কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৭ সালের রায়ের পর মন্ত্রণালয় দশম বিসিএস পর্যন্ত ৫০০ জনের ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তা আটকে যায়।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতিসহ সব সুযোগ–সুবিধা থেকে পিছিয়ে। দ্রুত এর প্রতিকার দরকার।মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব
বাদবাকি অন্যদের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর কোনো প্রস্তাব করেনি, তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতামত জানতে চেয়েছে। বঞ্চিত চিকিৎসকেরা বলছেন, মন্ত্রণালয় তাঁদের এই দুর্গতির কোনো কারণ বলেনি। পদোন্নতি আটকে থাকার কারণ হিসেবে কখনো হয়তো পদ না থাকার কথা শুনতে পান। তাঁরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
একজন বলেছেন, অনেক চিকিৎসক ১৬ থেকে ১৮ বছর ধরে একই পদে কাজ করছেন। এমন চিকিৎসকও আছেন, যিনি কোনো পদোন্নতি ছাড়া অথবা মাত্র একটি পদোন্নতি নিয়ে অবসরে গেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতিসহ সব সুযোগ–সুবিধা থেকে পিছিয়ে। দ্রুত এর প্রতিকার দরকার।