বিমানবন্দর
আটটির মধ্যে পাঁচটিই অরক্ষিত
দেয়াল টপকানোর ‘সুব্যবস্থা’ রাজশাহীতে। ভেতরে ঢুকে মানুষ ঘাস কাটে।
বরিশালে সীমানাপ্রাচীরের নিচ দিয়ে ফাঁকা। রাতে নেই আলোর ব্যবস্থা।
সৈয়দপুরে কাঁটাতারের বেড়া ফাঁকা করে ভেতরে ঢোকে মানুষ।
যশোরে শিয়ালের উৎপাত। কক্সবাজারে এখনো গরু চরে।
বিমানবন্দরের ভেতরে গরু চরে, গ্রামবাসী অবাধে ঢুকে ঘাস কাটে, মানুষ যাতায়াত করে, উৎপাত শিয়ালেরও—এরই মধ্যে ওঠানামা করে যাত্রীবাহী বিমান। গতকাল শুক্রবার বিমানবন্দরগুলো ঘুরে দেখা যায়, পাঁচটিই এমন অরক্ষিত।
দেশে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ওঠানামা করে এমন বিমানবন্দরের সংখ্যা ৮। এর মধ্যে ৩টি আন্তর্জাতিক, ৫টি অভ্যন্তরীণ। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। অরক্ষিত রাজশাহী, বরিশাল, সৈয়দপুর, যশোর ও কক্সবাজার বিমানবন্দর, যেখানে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট ওঠানামা করে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে গত মঙ্গলবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ উড্ডয়নের সময় ডান পাশের পাখায় দুটি গরুর
ধাক্কা লাগে। এতে গরু দুটি মারা যায়। যাত্রীরা রক্ষা পায়। এরপরই নিরাপত্তার বিমানবন্দরের বিষয়টি সামনে আসছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমানবন্দর অরক্ষিত থাকলে তা শুধু যে উড়োজাহাজ ওঠানামায় ঝুঁকি তৈরি করে, তা নয়; সার্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি হয়। এ কারণেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু জোর পাচ্ছে না অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলো।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতেই দেশে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়েছিল। ওই সময় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর তা ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান এক যুবক। দুবাইগামী উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর কমান্ডো অভিযান চালানো হয়। এতে ওই যুবক নিহত হন।
ঘটনার পর বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নিরাপত্তার কোনো ফাঁক রাখা হচ্ছে না। সবাইকে সতর্কভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও গতকাল বিমানবন্দরগুলো ঘুরে দেখা গেল নিরাপত্তায় ঢিলেঢালাভাব। গতকাল প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। তবে পাওয়া যায়নি।
উড়োজাহাজের সঙ্গে গরুর ধাক্কার পর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় দুর্ঘটনার আগেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা জরুরি।
দেয়াল টপকানোর ‘সুব্যবস্থা’ রাজশাহীতে
শুধু অভ্যন্তরীণ রুটের উড়োজাহাজ চলাচলকারী পাঁচটি বিমানবন্দরের একটি রাজশাহীর হজরত শাহ্ মখদুম বিমানবন্দর। গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, বিমানবন্দরটির রানওয়ের পাশে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ ঘাস কাটছেন। এই বিমানবন্দরের চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকলেও কোথাও কোথাও তা টপকে ভেতরে ঢোকার ‘সুব্যবস্থা’ রয়েছে।
রাজশাহী বিমানবন্দর জেলার পবা উপজেলার মধ্যে পড়েছে। রানওয়ের পশ্চিম পাশে বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম। এই গ্রামের মানুষেরা নিয়মিত বিমানবন্দরের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে রানওয়ের পাশে ঘাস কাটতে যান। গতকাল গিয়ে দেখা যায়, এক ব্যক্তি হাতে বস্তা ও হাঁসুয়া নিয়ে দেয়ালের ওপর বসে রয়েছেন। দেয়ালের ওপরে ওঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই ব্যক্তিকে অনুসরণ করে দেখা যায়, ভেতরে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ ঘাস কাটছেন। পাশেই একজন নিরাপত্তাপ্রহরী। যদিও তিনি কিছু বলেননি।
রাজশাহী বিমানবন্দরের রানওয়ের পূর্ব পাশে চালিকিপাড়া গ্রাম। এই অংশে বিমানবন্দরের দেয়াল টপকানোর জন্য রাবিশ (ভাঙা ভবনের পলেস্তারা ও অন্যান্য উপকরণ) ফেলে উঁচু করা হয়েছে। তার ওপর পা দিয়ে অনায়াসে দেয়ালের ওপর ওঠা যায়।
রাজশাহী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক দিলারা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, সকালে মানুষ ঢুকে ঘাস কাটে। তবে কার্যক্রম শুরুর আগেই তাদের বের করে দেওয়া হয়। বিকেলেও মানুষকে ঘাস কাটতে দেখা গেছে জানালে তিনি বলেন, এমন হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
বরিশালে দেয়ালের নিচে ফাঁকা
বরিশাল বিমানবন্দর দিয়ে এখন দৈনিক চারটি ফ্লাইট চলাচল করে। প্রশিক্ষণ ও সামরিক বাহিনীর উড়োজাহাজও ওঠানামা করে। যদিও বিমানবন্দরটি অরক্ষিত। এর সীমানাপ্রাচীর অনেকটা নিচু ও জরাজীর্ণ। দেয়ালের একটি বড় অংশের নিচে ফাঁকা, অর্থাৎ মাটি নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই ফাঁকা জায়গা দিয়ে শিশুরা বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে সাইকেল চালায়। অনেকে গরুর জন্য ঘাসও কাটেন। ছাগল ও অন্যান্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখা যায় প্রায়ই।
শুধু অরক্ষিতই নয়, বরিশাল বিমানবন্দরের আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সেখানে রাতে আলোর ব্যবস্থা নেই। ফলে সন্ধ্যার পর উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারে না। রানওয়ে ‘প্রয়োজনে’র তুলনায় সরু ও পাশে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা নেই। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারে নেই আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় দুটি রেসকিউ অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং (আরএফএফ) যান থাকলেও প্রয়োজনীয় লোকবল নেই।
বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক আ. রহিম তালুকদার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই বিমানবন্দর বহু বছর ধরেই এমন অরক্ষিত।
সৈয়দপুরে মই বেয়ে ভেতরে ঢোকে মানুষ
নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে এখন দৈনিক ১৫টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এর চারপাশজুড়ে রয়েছে ৭ ফুট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপর রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। তারপরও মানুষ ভেতরে ঢোকে।
সরেজমিনে গতকাল সৈয়দপুর বিমানবন্দরের পশ্চিমপাড়া, চৌধুরীপাড়া, মণ্ডলপাড়া, নিউ মুন্সিপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ায় জায়গায় জায়গায় বড় বড় ফাঁকা করা হয়েছে। এই ফাঁকা অংশ দিয়ে গ্রামের মানুষ বিমানবন্দরে ঢুকে রানওয়ের পাশের জমিতে ঘাস কাটে। চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা এহসান চৌধুরী বলেন, দেয়াল গত বছর সংস্কার করা হয়েছে। এরপর বিমানবন্দরে ঢোকার জন্য কাঁটাতারের বেড়া ফাঁকা করা হয়েছে।
রানওয়েতে ঢুকে পাশের জমিতে গ্রামবাসীর ঘাস কাটতে আসার বিষয়টি স্বীকার করেন সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে অনুপ্রবেশ বন্ধের ব্যবস্থা করা হবে।
যশোরে শিয়ালের উৎপাত
যশোর বিমানবন্দর থেকে এখন দৈনিক ১৭টি ফ্লাইট চলাচল করে। বিমানবন্দরটির দক্ষিণ-পূর্ব অংশ সীমানাপ্রাচীরে সুরক্ষিত। তবে উত্তর-পশ্চিমাংশ অনেকটা অরক্ষিত। এই অংশে সীমানাপ্রাচীর জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। কয়েকটি জায়গায় দেয়াল ভেঙে গেছে। সেখান দিয়ে মানুষ ও গরু-ছাগল প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। তবে পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিমানবন্দরটির বড় সমস্যা শিয়ালের উৎপাত। ভেতরে বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে কাশবন। এই কাশবনে শিয়াল বাস করে। বেসরকারি একটি এয়ারলাইনসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবস্থাপক বলেন, নিরাপত্তাপ্রহরীদের কারণে রানওয়েতে কখনো ছাগল-গরু দেখা যায়নি। তবে সন্ধ্যার দিকে শিয়াল রানওয়েতে চলে আসে। মাসে দু-একটা শিয়াল উড়োজাহাজের নিচে পড়ে মারা যায়। এ ছাড়া বিমানবন্দরের রানওয়েতে প্রচুর পাখি ওড়াউড়ি করে। এতে উড়োজাহাজ ওঠানামায় সমস্যা হয়।
বিষয়টি নিয়ে বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কথা বলতে রাজি হননি। তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিমাংশের সীমানাপ্রাচীর পুনর্নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
সিলেটে দুই স্তরের সীমানাপ্রাচীর
সিলেটের এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে রয়েছে দুই স্তরের সীমানাপ্রাচীর। একটি সীমানাপ্রাচীরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মানুষ ভেতরে ঢুকে ঘাস কাটে। তবে রানওয়ের আগে রয়েছে আরেকটি নিরাপত্তাপ্রাচীর। সরেজমিনে গতকাল দেখা যায়, বিমানবন্দরের লালবাগ দক্ষিণ এলাকায় সীমানাপ্রাচীরের নিচ দিয়ে দুটি সুড়ঙ্গ খোঁড়া রয়েছে। সুড়ঙ্গ দিয়ে মানুষ চলাচল করতেও দেখা গেছে।
বিমানবন্দরটির পরিচালক হাফিজ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিতীয় সীমানাপ্রাচীরটি ডিঙিয়ে মানুষ কিংবা প্রাণী কারও পক্ষেই রানওয়ে কিংবা সংরক্ষিত এলাকায় যাওয়ার সুযোগ নেই। রানওয়ের আশপাশে প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ টহল সড়ক রয়েছে। এ সড়ক ব্যবহার করে সার্বক্ষণিক রানওয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা তদারকি করা হয়।
কক্সবাজার তবু অরক্ষিত
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ভাঙা প্রাচীর ও কাঁটাতারের বেড়া গতকাল পর্যন্ত সংস্কার করা হয়নি। সকালে গিয়ে দেখা যায়, আগের মতোই ভাঙা দেয়াল দিয়ে মানুষ বিমানবন্দরে ঢুকে রানওয়ের ওপর দিয়ে নুনিয়াছটা ফিশারিঘাটের দিকে আসা-যাওয়া করছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা বাধা দিলেও কেউ মানছে না। কাঁটাতারের ছিঁড়ে যাওয়া অংশ দিয়ে গরু-ছাগল ঢুকে রানওয়ের পাশের জমিতে ঘাস খাচ্ছে।
এই বিমানবন্দরের রানওয়েতে উড়োজাহাজের সঙ্গে গরুর ধাক্কা লাগার ঘটনায় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আর দায়িত্বরত চার আনসার সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এখনো অরক্ষিত থাকার বিষয়ে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
‘দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নেই’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, কর্তৃপক্ষ যদি কোনো বিমানবন্দর করে, সেখানে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থা করতে হবে। কক্সবাজারে গরুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। সামনে যেন দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য এখনই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ এয়ারলাইন পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন এস এম হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরে নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নেই। দুর্ঘটনা ঘটার পর শুধু কথা হয়, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না। তিনি বলেন, ‘আমিও উড়োজাহাজ চালানোর সময় দেখেছি, ফ্লাইট ওঠানামার আগে রানওয়ে থেকে গরু তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট এবং যশোর অফিস ও প্রতিনিধি, সৈয়দপুর, নীলফামারী]