হাতে লাল-সবুজের পতাকা। পরনে সবুজ পাঞ্জাবি আর লাল কটি। মাথায় স্বাধীনতা দিবসের স্লোগান লেখা ব্যান্ড। বাবার সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আশফাক আনোয়ার। বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পেরে ভালো লাগছে।’ সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের কেজি শ্রেণির এই শিক্ষার্থীকে দেখে মনে হচ্ছিল, এক টুকরো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পূর্তি ও মহান স্বাধীনতা দিবস ছিল গতকাল শনিবার। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সীমিত পরিসরে ও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করতে হয়েছে। তবে এ বছর করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তাই গতকাল সকাল থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে আসা মানুষের মধ্যে ছিল অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ততা। শ্রদ্ধা জানাতে আসা নবীন-প্রবীণেরা নিজেদের অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহর-গ্রামে যে যেভাবে পেরেছেন, স্বাধীনতার আনন্দ উদ্যাপনে শামিল হয়েছেন। সারা দেশে প্রত্যুষে তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটি উদ্যাপনের সূচনা হয়। স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে এদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকাল সাড়ে ছয়টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করে এবং বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। পরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সেখানে রাখা দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। পরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আরেকবার পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান।
প্রতিবন্ধকতা জয় করে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে আসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ১৩ সদস্যের একটি দল। হুইলচেয়ারে বসে সবার সঙ্গে তাঁরাও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। প্রতিবছর পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) উদ্যোগে এ প্রতিষ্ঠানে থাকা কিছু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে আনা হয়।
শারীরিক প্রতিবন্ধী রুবেল তালুকদার বলেন, ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর আমাদের মতো প্রতিবন্ধীদের কেউ না কেউ স্মৃতিসৌধে আসেন। আমরাও এসেছি। দেশের বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে প্রশান্তি অনুভব করছি।’
রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে ছয় বছরের মানহা আর তিন বছরের মুরসালিনও জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসেছে মা-বাবার সঙ্গে। হাতে জাতীয় পতাকা; মাথায়ও পতাকা বাঁধা। পরিবারের সবার পরনে লাল-সবুজের পোশাক। শহীদদের স্মরণে ফুল দেওয়া শেষে ছবি তুলছিল পরিবারটি।
মানহা-মুরসালিনের মা রায়হানা আফরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চাদের স্মৃতিসৌধ দেখাতে নিয়ে এসেছি। আজ সকাল থেকেই বাচ্চারা বলছিল, লাল-সবুজ রঙের জামা পরবে। করোনার কারণে আগের দুই বছরে সেভাবে বের হতে পারিনি।’
প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীর মিছিল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাভারের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার হলি সোল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকেরা। শ্রদ্ধা জানানো শেষে সমবেতভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে শিক্ষার্থীরা। স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জুনায়েদ আল রাকিব জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, ‘যাঁদের জন্য এই স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।’
সকাল সোয়া নয়টার দিকে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জনগণের ভোটের অধিকার নেই, স্বাধীনতা নেই, সংগঠনের অধিকার নেই। আজকে এখানে শপথ নিয়েছি, ৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম, এখন আবারও গণতন্ত্রকে মুক্ত করব।’
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শরীরচর্চার মাধ্যমে সুস্থ থেকে দেশের জন্য নিজেদের গড়ে তোলার শপথ নেয় ‘পাপ্পুরাজ কারাতে একাডেমি’র শিশু-কিশোরেরা। স্মৃতিসৌধ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী নানা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে। একপর্যায়ে একজনের কাঁধের ওপর আরেকজন উঠে তৈরি করে মানব সৌধ। সৌধের সবার ওপর একজনের হাতে পতপত করে উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা।
স্মৃতিসৌধের বেদিতে ৬০ ফুট দীর্ঘ জাতীয় পতাকা নিয়ে শ্রদ্ধা জানান গাজীপুরের ইকবাল সিদ্দিকী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারিতে থাকা জাতীয় পতাকাটি দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সৌধ থেকে রক্তিম পতাকাটি নেমে আসছে।
শিক্ষার্থী সায়েমা ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বীর শহীদদের সম্পর্কে আমরা আরও ভালোভাবে জানতে চাই। প্রথমবারের মতো জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পেরে ভালো লাগছে।’
স্মৃতিসৌধ এলাকায় রোদের তাপের পাশাপাশি মৃদু বাতাস বইছিল। সপরিবার আসা অনেকেই শ্রদ্ধা জানানো শেষে স্মৃতিসৌধের চারপাশের লেকের ধারে, গাছের ছায়ায় বসে নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছিলেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আনিসুল ইসলাম স্ত্রী ও সাত বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে এসেছেন সাভারের থানা স্ট্যান্ড এলাকা থেকে। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাকে স্বাধীনতা দিবসের কার্যক্রম দেখাতে নিয়ে এসেছি। আগের দুই বছর তো আসা হয়নি।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। সকাল নয়টা থেকে স্মৃতিসৌধ এলাকায় উন্মুক্ত স্থানে এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রশিল্পীরা।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই, অথচ স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরুই হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। সেই গণতন্ত্র আস্তাকুঁড়ে চলে গেছে। দেশে এখন সীমাহীন বৈষম্য ও দারিদ্র্য বেড়েছে; চাকরি নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো ইতিবাচক পথ আছে। সরকার সেগুলোর কোনোটিতেই হাঁটছে না।’
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, গণফোরাম, জাকের পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, নিরাপদ সড়ক চাই। শ্রদ্ধা নিবেদন করে শ্রমিকদের একাধিক সংগঠনও।