গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
‘অসত্য’ তথ্য পেট্রোবাংলার
উৎপাদন পর্যায়ে গ্যাসের খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করেনি জ্বালানি বিভাগ। বাড়তি দাম দেখিয়ে বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে পেট্রোবাংলা।
২০২১-২২ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য হিসাবে বাপেক্সসহ তিন কোম্পানির খরচ বাড়তি দেখানো হয়েছে।
নতুন প্রস্তাব অনুমোদন হলে বাপেক্সের ইউনিটপ্রতি গ্যাসের খরচ মার্কিন কোম্পানি শেভরনের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি হবে।
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন পর্যায়ে খরচ ইউনিটপ্রতি ২৬ থেকে ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কাছে প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। এটি অনুমোদন হওয়ার আগেই প্রস্তাবিত খরচ ধরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে তারা। এ ছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির লক্ষ্যমাত্রাও বেশি দেখানো হয়েছে খরচের হিসাবে।
গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে পেট্রোবাংলা গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রস্তাবের সঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের একটি সম্ভাব্য হিসাব দিয়েছে সংস্থাটি। এতে গ্যাস উৎপাদনকারী দেশীয় তিনটি কোম্পানির ইউনিটপ্রতি খরচ বাড়তি দেখানো হয়েছে।
তবে পেট্রোবাংলা গত বুধবার পর্যন্ত এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন জমা দিতে পারেনি। বিইআরসির পরিচালক (গ্যাস) মহম্মদ আলী বিশ্বাস বলেন, অনুমোদনের চিঠি চাওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে। চিঠি জমা দিতে না পারলে আগের খরচ ধরে হিসাব করা হবে।
দেশে গ্যাস সরবরাহের ৭৩ শতাংশের জোগান আসছে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। বর্তমানে তিনটি দেশীয় ও দুটি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি গ্যাস উৎপাদন করছে। বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত দামে গ্যাস কেনে পেট্রোবাংলা। আর পেট্রোবাংলার প্রস্তাবের ভিত্তিতে দেশীয় তিন রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান প্রথম আলোকে বলেছেন, মন্ত্রণালয়কে জানিয়েই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানো হয়েছে।
বিইআরসিতে পাঠানো পেট্রোবাংলার হিসাবে দেখা গেছে, বিদেশি কোম্পানি শেভরনের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস তারা কিনছে ২ টাকা ৯০ পয়সায়। আর দেশীয় তিন কোম্পানির ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম না ধরে একটি খরচের হিসাব করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ইউনিটপ্রতি বর্তমান খরচ ৭০ পয়সা, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) ২০ পয়সা ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) ৩ টাকা।
বিজিএফসিএলের ইউনিটপ্রতি খরচ ২৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৮ পয়সা হিসাব করেছে পেট্রোবাংলা। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফা ২১৫ কোটি টাকা। বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ ২১ পয়সা বেড়েছে। এ বছর হয়তো লোকসান হবে না। আগামী বছর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে লোকসানে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
এসজিএফএলের ইউনিটপ্রতি খরচ ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ পয়সা থেকে ৩৩ পয়সা ধরেছে পেট্রোবাংলা। সর্বশেষ অর্থবছরে ২৩৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এসজিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে। উৎপাদন বাড়াতে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ খনন করা হচ্ছে। সব মিলে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি তা উৎপাদনের কাজ করে বাপেক্স। প্রতিষ্ঠানটির গ্যাসের ইউনিটপ্রতি খরচ ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৪ টাকা হিসাব করেছে পেট্রোবাংলা। গত বছর প্রায় ১৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বাপেক্স। গ্যাস উত্তোলনে চড়া দামে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ করে খরচ বাড়ানোর অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। নতুন প্রস্তাব অনুমোদন হলে বাপেক্সের ইউনিটপ্রতি গ্যাসের খরচ মার্কিন কোম্পানি শেভরনের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি হবে।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, গত অর্থবছরে খুবই সামান্য মুনাফা হয়েছে। গ্যাসের উৎপাদনসহ সব ধরনের খরচ বাড়ছে। সব মিলে যৌক্তিক কারণেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আগামী ২১ মার্চ থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি করবে বিইআরসি। প্রস্তাবের যৌক্তিকতা যাচাই করতে ইতিমধ্যে কমিশন গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি কাজ শুরু করেছে। পেট্রোবাংলার আয়-ব্যয়ের পক্ষে সব কাগজপত্র চাইছে বিইআরসি। বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, অনুমোদনপত্র ছাড়া উৎপাদন পর্যায়ে খরচ বাড়ানোর বিষয়টি কমিশন বিবেচনা করবে না।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ২০১৯ সালে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময়ও দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলা হয়েছিল। আনা হয়েছে অর্ধেকের কম। এবারও ৮৫ কোটি ঘনফুট ধরে খরচের হিসাব করা হয়েছে। চড়া দামে এলএনজি আমদানির মধ্যে দেশীয় গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।
পেট্রোবাংলার একটি সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে দিনে ৪৫ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস পাওয়া যাবে। আর বাকি চাহিদা মেটাতে ৪৫টি এলএনজির কার্গো খোলাবাজার থেকে আমদানির খরচ হিসাব করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এসেছে ৬টি। আর ১৪টি কেনা হতে পারে। অর্থাৎ বিইআরসিতে জমা দেওয়া হিসাবের চেয়ে ২৫টি এলএনজির কার্গো কম আসবে।
এ বিষয়ে ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় তিনটি কোম্পানি লাভে থাকার পরও দাম বাড়াতে চাইছে। এটা নিয়ে তো গণশুনানিও হবে না। ওয়াসার পানির মতো দাম বেড়ে যাবে। আবার এলএনজির হিসাবও আগের মতো বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে গ্রাহকের ওপর গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় তারা।