অবরোধে আরও ৯ জন নিহত
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের অবরোধে গতকাল বুধবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আগুন, রেললাইনে নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ ও অবরোধকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে।
আর এতে আরও নয়টি পরিবার স্বজনহারা হলো। এর মধ্যে গাইবান্ধায় রেলে নাশকতায় চারজন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ ও ফেনীতে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। ঢাকায় বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আরও একজন গতকাল প্রাণ হারিয়েছেন। ঢাকার নবাবগঞ্জে অবরোধের সময় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে অসুস্থ হয়ে যুবদলের এক নেতা মারা গেছেন।
গত শনিবার শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফার অবরোধে এ নিয়ে মোট ২৮ জন প্রাণ হারালেন। এর আগে ২৬ নভেম্বর থেকে ৭১ ঘণ্টার অবরোধে প্রাণ হারান ২২ জন। আট দিনের অবরোধে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫০ জনে।
অবরোধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই সারা দেশে ট্রেনে আগুন ও রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়। একইভাবে রেললাইনের ফিশপ্লেট ও ক্লিপ খুলে ফেলায় বুধবার রাত দেড়টার দিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া ও মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশনের মাঝামাঝি ভূরঙ্গী এলাকায় পদ্মরাগ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি উল্টে যায়। এ ঘটনায় চারজনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। এতে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫০ জন।
ফেনীতে গতকাল বুধবার বিকেলে জেলা যুবদল একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি শহরের ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্বরের কাছাকাছি গেলে যুবলীগের কর্মীরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। মিছিলটি পিছিয়ে শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের দিকে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে।
এ সময় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা তাঁদের ধাওয়া করে শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে মারেন। এ সময় যুবদল কর্মীরা ওই সড়কের ‘শহর পুলিশ ফাঁড়িতে’ ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও হামলা করেন। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদলের নেতা হারুনুর রশিদ (৩২) মারা যান।
এ সময় পুলিশের তিন সদস্যসহ অন্তত ৫০ আহত হয়েছেন। ঘটনার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার ফেনীতে যুবদল-ছাত্রদল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।
কিশোরগঞ্জের চৌদ্দশত বাজারে মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে অবরোধকারীদের ধাওয়ার মুখে একটি পিকআপ ভ্যানের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে পিকআপচালকের পাশে বসে থাকা মালিক উজ্জ্বল সরকার নিহত হন। পুলিশ জানিয়েছে, পিকআপটি ১৮ জন ইটভাটার শ্রমিক নিয়ে কুমিল্লায় যাচ্ছিল। অবরোধের কারণে অতি সতর্কতার কথা মাথায় রেখে উজ্জ্বল মিয়া নিজেই চালক রুবেল মিয়ার পাশে বসেন। পিকআপটি ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ভৈরব মহাসড়কের চৌদ্দশত বাজার এলাকা অতিক্রমের সময় অবরোকারীরা বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এ সময় চালকের বুকে ও মাথায় ইটের আঘাত লাগলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে সড়কের পাশে একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং পরে উল্টে যায়। গুরুতর আহত উজ্জ্বল সরকারকে কিশোরগঞ্জ জেলা হাসপাতালে আনার কিছুক্ষণ পর তাঁর মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় আহত আরও সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সাতক্ষীরায় অবরোধ চলাকালে আলাউদ্দিন খোকন (৬৫) নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে কুপিয়ে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত খোকনের মেয়ে ফাতেমা খাতুন জানান, প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার রাতের খাবার শেষে তাঁর বাবা বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ১২টার দিকে কে বা কারা মাথা কুপিয়ে পাশের ডোবায় ফেলে রেখে যায়। রাত একটার দিকে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু অবরোধের কারণে কালীগঞ্জের সঙ্গে সাতক্ষীরার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া যায়নি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ ওহিদুজ্জামান অভিযোগ করেছেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কুপিয়ে তাঁকে খুন করেছেন।
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সড়কে মিছিল ও গাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ এ সময় ধাওয়া করলে জাহাঙ্গীর আলম নামে যুবদলের এক নেতা হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। নবাবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির একাংশের সভাপতি আবেদ হোসেন বলেন, পুলিশের ধাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান।
ঢাকায় শাহবাগে গত বৃহস্পতিবার বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ ১৯ জনের একজন ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমান ওরফে বাবু। আগুনে তাঁর শরীরের ২৮ শতাংশ পুড়ে যায়। গতকাল ভোর সাড়ে চারটার দিকে তিনি মারা যান।
গাইবান্ধা ছাড়াও অবরোধ চলাকালে গতকাল বিভিন্ন স্থানে রেলে সহিংসতা হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুরের মেঘনা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি এবং খুলনায় নকশীকাঁথা ট্রেনের ইঞ্জিনসহ পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে অবরোধকারীরা। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ষোলশহর, হাটহাজারী, রংপুরের পীরগঞ্জ, নাটোর, শেরপুর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ ও বরিশালে অবরোধ চলাকালে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছেন অবরোধকারীরা। এ সময় বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
গাজীপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গাজীপুর-১ আসনের সাংসদ আ ক ম মোজামেঞ্চল হকের বাসায় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে অগ্নিসংযোগ করেছে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। গতকালও বগুড়ায় পত্রিকাবাহী গাড়িতে অবরোধকারীরা হামলা চালিয়েছেন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করেন অবরোধকারীরা।
১৮ দলের অবরোধ চলাকালে গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে বংশাল থানা ছাত্রদলের কর্মীরা নর্থ সাউথ রোডের বংশালের কাছে ককটেল ফাটান। পরে তাঁরা সদরঘাট থেকে গুলিস্তানগামী যাত্রীবাহী বাস ইউনাউটেড পরিবহনের একটি বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া গতকালও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা ও সাতক্ষীরার নিজস্ব প্রতিবেদক, গাইবান্ধা, ফেনী ও কিশোরগঞ্জ অফিস এবং ঢাকার নবাবগঞ্জসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)