গৌরব তার অক্ষয়
কেন মানুষ দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়? কেন নিখাদ পরার্থপরতা, বিপদে একটুখানি শক্তি অথবা সাহায্য জোগানো, একটি বিপন্ন প্রার্থনা কিছুটা হলেও ফলে যেতে ভূমিকা রাখা, কেন ঘটে?
মার্চের শুরু থেকে প্রবল বেগে সারা বিশ্বে মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তার আঘাতে বিপর্যস্ত হলো অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিত্যদিনের জীবনযাপন; অন্ধকারে ছেয়ে গেল স্বাস্থ্য আর শিক্ষাচিত্র; বিপন্ন হলো মানবিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ। সংস্কৃতি আমাদের যা শিখিয়েছে এত দিন, তার মূল ধরেই টান দিল মহামারির চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যবাধকতাগুলো। মানুষ ঢুকে গেল ঘরের কোণে, একান্ত বুদ্বুদে। স্বার্থপরতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি হলো।
শুরুতে আমার একটা বিশ্বাস ছিল, এবং একটা শঙ্কাও ছিল, মহামারি-উত্তর পৃথিবীটা নিয়ে; হয় এটি আরও মানবিক হবে, নয় ডারউইনের টিকে থাকার তত্ত্ব মেনে আরও ভয়ানক হবে। মহামারি স্থায়ী হতে থাকলে বিশ্বাসটা ফিকে হতে শুরু করল, ভয়টা বাস্তব রূপ নিল। দিন যত যাচ্ছে, সামাজিক বৈষম্য তত বাড়ছে; দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অপুষ্টি আর বেকারত্বের মাত্রা এবং হার ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। কোভিড-বিনাশী টিকা এবং প্রতিষেধক যখন পাওয়া যাবে, তখন কারা প্রথম সুরক্ষিত হবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। হায় মানুষ!
মহামারির শুরুতে যখন ঘূর্ণিঝড় আর বন্যার তাণ্ডব বাংলাদেশের মানুষকে দিশেহারা করছে, তখন সরকারের দেওয়া ত্রাণ লুটপাটের উৎসব, এবং ওষুধ আর খাদ্যসামগ্রী মজুত করে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা করার যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো, সেসব দেখে মনে হয়েছিল, আমরা বিবর্তনের যে পর্যায়ে আছি, তাতে বোধ হয় পূর্ণ মানুষ এখনো হতে পারিনি। ঘরবন্দী জীবনে কম্পিউটারের পর্দায় পড়ানো শুরু করলে দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎশের দ্য জিনিওলজি অব মরালস বইটা শেষ করতে হয়েছিল। সেটি পড়তে পড়তে ভেবেছি, তিনি যে বলেছেন মানুষ প্রবৃত্তিনির্ভর প্রাণী, তার অন্ধকার প্রকাশটা কি আমরা এ দেশে দেখছি? যুক্তিতর্ক ছাপিয়ে অন্ধকার প্রবৃত্তির জয়জয়কার? একটা সময় যখন কিছু বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ত্রাণকাজে নামল এবং বিশাল ব্যানারে সেই মহৎ কর্মের ঘোষণা লিখে ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে চাল-ডাল-সাবান দুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করল, নিৎশের আরেকটা কথাও দেখলাম বেশ খেটে গেল। তিনি বলেছিলেন, নৈতিক সচেতনতা হচ্ছে ক্ষমতার প্রভাবের একটা কৌশল, যার মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আত্মস্থ করে নেওয়া যায়। আহা রে মানুষ!
তবে একটা মুদ্রার দুটি পিঠ থাকে; ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দরও যুগলবন্দী হয়ে আসে। এই মহামারিতেও দেখা গেল পরার্থপরতা মোটেও হারিয়ে যায়নি, মানুষ এখনো দাঁড়ায় মানুষের জন্য, জীবন দিয়ে এখনো জীবন বাঁচায় মানুষ। সবাই যখন আতঙ্কে ছিল কোভিড নিয়ে, সন্তানও আক্রান্ত মা-বাবাকে ফেলে গা বাঁচাতে পালিয়েছে, তখন ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা কোভিড-পীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা নিজেরা আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মারাও গেছেন। বাড়িতে বুদ্বুদবাসী হয়ে বসে থাকলে নিশ্চয় তাঁরা এখনো পরিবারের, নিকটজনের সঙ্গে থাকতেন। যে পুলিশ নিয়ে আমাদের বিস্তর অভিযোগ, তাঁরাও দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে, তাঁদের অনেকেও কোভিডের শিকার এবং বলি হয়েছেন। যখন ঢাকাতে আমার পাড়ায় লকডাউন চলছে, দেখেছি পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ময়লা সরাচ্ছেন, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা মশকনিধনে নেমেছেন, যেহেতু ডেঙ্গুর ভয়টাও ছিল। ভুখা মানুষকে আহার জুটিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো হয়েছে, কিন্তু তাদের কাজ থেমে থাকেনি। কিছু তরুণ এক টাকার খাবার প্রকল্প নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এক ওয়ার্ড কমিশনার মাকসুদুল আলম খন্দকার, যাঁকে মানুষ খোরশেদ নামেই চেনে, কোভিডে মৃতদের লাশ দাফন ও সৎকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। জাতপাতের হিসাব তিনি করেননি, মানুষের কাজটিই করে গেছেন। সস্ত্রীক কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, সুস্থ হয়ে আবার তাঁর কাজে ফিরে গেছেন। কিছু তরুণ লেখক-কবি মিলে বন্যার ত্রাণ নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে গেছেন। খবরের কাগজের পাঠক সংগঠনগুলোও ত্রাণ দিয়েছে।
বিপদে মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোটা ব্যতিক্রম হলে মহামারি নিয়ে আমার শঙ্কাটা দূর হতো না, আমাকে তা অধিকার করেই রাখত। তা হয়নি কারণ, পরার্থপরতাটা এখনো এ দেশে ব্যতিক্রমের খাতায় চলে যায়নি। ওপরে যেসব উদাহরণ দিলাম, সেগুলো মিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সৌজন্যে আমাদের জানা। কিন্তু এগুলোর দৃষ্টির বাইরে বিশাল বাংলার আনাচে–কানাচে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনেক ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করায় আমার একটা সুবিধা হয়েছে এই, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আমার ছাত্রছাত্রীরা অনেক ভালো কাজের খবর আমাকে দেয়।
তবে একটা মুদ্রার দুটি পিঠ থাকে; ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দরও যুগলবন্দী হয়ে আসে। এই মহামারিতেও দেখা গেল পরার্থপরতা মোটেও হারিয়ে যায়নি, মানুষ এখনো দাঁড়ায় মানুষের জন্য, জীবন দিয়ে এখনো জীবন বাঁচায় মানুষ।
আমি জেনেছি, এক উপজেলার তরুণ নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর বেতনের টাকায় ঈদে অনেক গরিব পরিবারকে উপহার কিনে দিয়েছেন, এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার তাঁর সঞ্চয় তুলে দিয়েছেন একটি পরিবারের কোভিডে মৃত একমাত্র উপার্জনকারীর স্ত্রী–পুত্রের হাতে, এক গঞ্জের তরকারি ব্যবসায়ী এক মাস দুটি পরিবারের আহার জুটিয়েছেন। এ রকম আরও অনেক খবর। এঁরা কেউই প্রচার চাননি। দিয়েছেন গোপনে, যেমনটি আমাদের একসময় শেখানো হতো, ডান হাত দেবে, বাঁ হাতটি তা জানবে না।
কিছু প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে: কেন মানুষ দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়? কেন নিখাদ পরার্থপরতা, বিপদে একটুখানি শক্তি অথবা সাহায্য জোগানো, একটি বিপন্ন প্রার্থনা কিছুটা হলেও ফলে যেতে ভূমিকা রাখা, কেন ঘটে? কেন প্রতিদানহীন দান, দয়া অথবা ভালোবাসার উদাহরণ সৃষ্টি হয়? কারণটা কোথায় লুকিয়ে? উত্তর খুঁজতে সাহায্য করল একটা নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ। মেয়েরা অবলা বলে একটি কথা সমাজে চালু আছে, মেয়েরা ছেলেদের মতো দ্রুত দৌড়াতে অথবা লাফ দিতে পারে না। এ রকমও বলা হয়, যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতা তা–ই বলে। কিন্তু মানুষ যখন তার প্রজাতি বিকাশের শিকার-চক্রে ছিল, যখন পুরুষেরা প্রাণী হত্যা করত, নারীরা সন্তান পালন করত, তখন পুরুষদের দৌড়াতে হতো ক্ষিপ্রগতিতে, আর নারীদের হাঁটতে হতো টলমল পায়ে হাঁটা সন্তানের গতির সঙ্গে সংগতি রেখে। সেই হাঁটা এখনো তো জারি আছে! অর্থাৎ জৈবিক কারণ থেকে, বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে আদি মানুষ প্রবৃত্তির মন্দ প্রকাশের সঙ্গে ভালো প্রকাশটা শিখেছে। অর্থাৎ দয়াদাক্ষিণ্য ছাড়া মানুষ টিকে থাকত না। অর্থাৎ মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোটা মানবসভ্যতার একটা ভিত্তি।
অনেকে হয়তো বলবেন, বিবেকের কারণে মানুষ এই কাজ করে। হয়তো সুপ্রবৃত্তির আরেক নাম বিবেক। তবে নীতিনৈতিকতার আর বিবেকের দুষ্প্রাপ্যতার সময়ে শুধু প্রবৃত্তির আলোময় দিকটা দিয়ে যদি মানুষ অন্ধকার দিকটা ঢেকে দিতে পারে, তাহলে মানুষ টিকে থাকবে মানুষ হিসেবেই। যেসব মানুষ এটি ক্রমাগত করতে পারে, তাদের সংখ্যা যে সমাজে বেশি, সে সমাজ মানবিক হয়। এদের উদ্যাপন সবাই করে। আমরাও। রবীন্দ্রনাথও করেছেন, বলেছেন, এদের গৌরব অক্ষয়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক