উন্নয়নের ঝুঁকি কমেনি

করোনার কারণে আমরা ‘গর্তে’ পড়ে ছিলাম। আমরা এখন পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। এই পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ায় যদি স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে।

জাহিদ হোসেন
ফাইল ছবি

দেশের অর্থনীতিতে নজিরবিহীন সংকট তৈরি করেছে করোনাভাইরাস। এ সংকট শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই চলছে। তবে বাংলাদেশের সংক্রমণ পরিস্থিতির সঠিক চিত্র কী, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। দেশের কোভিড–১৯ সংক্রমণের তথ্য-উপাত্তে বিভ্রান্তি আছে। ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না।

করোনার কারণে দেশের সবাই অর্থনৈতিকভাবে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়। অনেকেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়ে কথা বলছেন। করোনায় দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ বিশাল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ কেউ অবশ্য লাভবানও হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ৪০ কোটি বা এর বেশি টাকা আছে, এমন হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ গত মার্চের তুলনায় জুনে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে ৫ হাজার বা এর কম টাকা আছে, এমন হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ৭ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। এমন হিসাব মোট হিসাবসংখ্যার ৭২ শতাংশ। এর মানে কারও কারও অবস্থার উন্নতি হলেও জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের শহরের দরিদ্র শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর করোনার আঘাত বেশি পড়েছে। পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিভিন্ন গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বস্তি ও দরিদ্র এলাকার ৭৬ শতাংশ শ্রমজীবী কাজ হারিয়েছেন। চট্টগ্রামে কাজ হারিয়েছেন ৫৯ শতাংশ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই শ্রমবাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। চাহিদা না থাকায় তাঁরা এখন আর কাজ খুঁজছেন না। তাঁরা মনে করছেন, কাজ খুঁজেও লাভ নেই, কাজ পাবেন না। যাঁরা এখনো কাজের মধ্যে আছেন, তাঁদের অনেকের আয় কমে গেছে। চায়ের দোকান খোলা থাকলেও বেচাকেনা আগের মতো নেই। সারা দিন রিকশা চালিয়েও আগের মতো আয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, দিনমজুর ও রিকশাচালকদের ওপর আয় কমে যাওয়ার প্রভাব বেশি পড়েছে।

সার্বিকভাবে, গরিব লোকের সংখ্যা বেড়েছে। পুরোনো গরিবেরা আরও গরিব হয়েছেন। সরকারি হিসাব বলছে, দারিদ্র্যের হার ৯ শতাংশীয় পয়েন্টে বেড়েছে। অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশীয় পয়েন্ট।

ঢাকা শহরের বস্তি ও দরিদ্র এলাকার ৭৬ শতাংশ শ্রমজীবী কাজ হারিয়েছেন। চট্টগ্রামে কাজ হারিয়েছেন ৫৯ শতাংশ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই শ্রমবাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। চাহিদা না থাকায় তাঁরা এখন আর কাজ খুঁজছেন না। তাঁরা মনে করছেন, কাজ খুঁজেও লাভ নেই, কাজ পাবেন না

গত এপ্রিল ও মে মাসে জনসাধারণের চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। তখন অর্থনীতি প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সরকারও সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, চলাচলে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা উদ্যোগ নেয়। কিন্তু জুনের পর এসব বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। গুগল মোবিলিটি সূচক বলছে, মানুষের চলাচল করোনার প্রায় আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে জনগণের চলাচল যে মাত্রায় ছিল, অক্টোবরে এসে তা মাত্র ৯ শতাংশ কম। চলাচল বেড়ে যাওয়ায় অবশ্য অর্থনীতিতে গতি এসেছে। সার্বিকভাবে রপ্তানি বেড়েছে। তবে নিট পোশাকের রপ্তানি বাড়লেও ওভেন পোশাক, চামড়াপণ্য রপ্তানির পরিস্থিতি ভালো নয়। গত কয়েক মাসে আমদানি পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে কমেছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না। চাহিদা না থাকায় বিদ্যমান উৎপাদন–সক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। তাহলে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ পাবেন কী করে?

আমি মনে করি, অর্থনীতি তলানি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মাত্র। করোনার কারণে আমরা ‘গর্তে’ পড়ে ছিলাম। সেখান থেকে উঠে আসতে পারিনি। তবে উঠে আসার চেষ্টা করছি। আমরা এখন পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। এই পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ায় যদি স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে। আবার গর্তের নিচের দিকে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। চলমান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ায় গর্ত থেকে উঠতে কিছু লোকের ‘সিঁড়ি’ দরকার। এই সিঁড়ি হলো সরকারের প্রণোদনা সহায়তা। কাজ হারানো, আয় কমে যাওয়া, গরিব হয়ে যাওয়া এসব দরিদ্র মানুষের এই প্রণোদনা বেশি জরুরি।

শুধু বাজারের ওপর নির্ভর করলে এই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। কেননা, বাজারের নিজস্ব চরিত্র দিয়ে স্বাভাবিকভাবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হয়ে যাবে, এটা ভুল ধারণা। সিঁড়ি বা সরকারের সহায়তা অবশ্যই লাগবে। এ সহায়তা দুইভাবে দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের এখনো জীবিকার সংকট আছে, তাঁদের কাছে নগদ ও খাদ্যসহায়তা পৌঁছাতে হবে। ছোট ব্যবসায়ীদের পরিচালন মূলধন দিতে হবে। এই অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে না পারলে লাখ লাখ লোকের জীবিকার সংকট কাটবে না। শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলেও এখন তা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, করোনা–পরবর্তী অর্থনীতি অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হবে। এতে ধনী-গরিবের মধ্যে প্রযুক্তির বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। তাই প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সহজলভ্য করতে ঘরে ঘরে স্মার্টফোন পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

করোনার মধ্যে অর্থনীতির কিছু ভালো খবরও আছে। সামষ্টিক অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে সুসংহত। বিদেশি ঋণের বোঝা কম। আর বিদেশি মুদ্রার মজুত ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তির বিষয়। কারণ, এ দেশে বিনিয়োগ করে মুনাফার অর্থ ডলারে রূপান্তর করে তাদের নিজ দেশে নিয়ে যেতে সমস্যা হবে না।

করোনায় অর্থনীতি যে নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে, তা থেকে মূলত তিন ধরনের শিক্ষা নিয়েছি। প্রথমত, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু করোনার মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি, বিশ্বব্যাপী কোনো সংকট তৈরি হলেও এ ধরনের বড় অর্জন বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমরা উন্নয়নের ঝুঁকি কমাতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় বলা হয়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে দেশজ উপায়ে স্বল্প মূল্যের চিকিৎসাপদ্ধতি বিশ্বজুড়েই খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। যেমন ডায়রিয়ার ওরস্যালাইন কিংবা এনজিওর সহায়তা বাড়ি বাড়ি টিকা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু করোনা সংকটে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল এ খাতের বিনিয়োগের ঘাটতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে ১৪০টির বেশি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে। কিন্তু বিপদের সময় এগুলো অবলম্বন হিসেবে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। সুরক্ষা কর্মসূচিতে বেশ দুর্বলতা আছে। করোনার সময়ে অতি দরিদ্রদের সহায়তা দিতে তালিকা করতেই তিন মাস চলে যায়। সেই তালিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সার্বিকভাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো করোনাকালে হতাশ করেছে।

পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ায় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিজ্ঞানের ব্যবহার সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি প্রধান উপাদান। করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে নিউজিল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের চেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানকে প্রাধান্য দিয়ে সফল হয়েছে


এমন অবস্থায় ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনিশ্চয়তাই একমাত্র নিশ্চয়তা। দেশের অর্থনীতির পুরোপুরি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নির্ভর করছে দেশে-বিদেশে ভাইরাসের গতিপথ ও ক্ষিপ্রতার ওপর। এর পাশাপাশি সরকার কতটা কার্যকর নীতিসহায়তা নিতে পারছে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি এর ওপর নির্ভর করছে।
একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন সর্বসাধারণের কাছে যত দিন পৌঁছাতে না পারব, তত দিন কোভিড–১৯ ভাইরাসের ক্ষিপ্রতা অব্যাহত থাকবে। ওই সময় পর্যন্ত ভাইরাসটি মোকাবিলায় জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যেন এই ভাইরাসের কারণে পণ্য ও সেবা সরবরাহের ব্যবস্থা বিঘ্নিত না হয়। এর পাশাপাশি বর্তমান উৎপাদন–সক্ষমতা সচল রাখতে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে চাহিদা ধরে রাখার নীতিও বজায় রাখতে হবে। কারণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা টেকসই হবে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ায় সুশাসনের ভূমিকা অতিরঞ্জিত নয়। পুনরুদ্ধার–প্রক্রিয়ায় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিজ্ঞানের ব্যবহার সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি প্রধান উপাদান। করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে নিউজিল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের চেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানকে প্রাধান্য দিয়ে সফল হয়েছে। অর্থনীতি খুলে দিয়ে তা টেকসই করা যাবে না, যদি না তা নিরাপদ হয়।

আমরা দেখেছি, করোনাকালে দেশটি বিজ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নীতি নির্ধারণ করে কীভাবে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে মূলধারা থেকে বিচ্যুত করে ফেলেছে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নীতিকে অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। আবেগতাড়িত না হয়ে তথ্য-উপাত্তের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বাংলাদেশে পুনরুদ্ধার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এমন নীতি গ্রহণ না করে বিপাকে পড়ার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র।

জাহিদ হোসেন: বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ