মেয়েটার মধ্যে নিজের মেয়ের ছবি দেখেছি

চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের কিছু নৈতিক দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সড়ক, ভ্যাট ও কোটা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশে ছিলাম। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষাটা পেয়েছি পরিবার থেকে। আমার বাবা মনিরুল হক চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। সারা জীবনই তিনি রাজনীতি করেছেন।

বাবা আমাকে বড় করেছেন একজন শিক্ষক হিসেবে। তবে ২০১৮ সালে রাজনীতির সঙ্গে অনেকটা বাধ্য হয়েই জড়িয়ে পড়ি। আমার বাবাকে নির্বাচনের ঠিক আগে দিয়ে ৮৪ দিনের জন্য জেলে পাঠানো হয়েছিল, একেবারে মিথ্যা মামলায়। সেই সময়ে সারা দেশেই বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার চলছিল। আইন লঙ্ঘন করে বাবাকে যেদিন কারাগারে পাঠানো হলো, ছুটে গিয়েছিলাম আদালত প্রাঙ্গণে জবাব চাইতে। সেদিন অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম, কী লজ্জাজনকভাবে আদালত প্রাঙ্গণ কলুষিত করেছিল তারা। বাবার সঙ্গে অন্যায় মেনে নেয় না কোনো সন্তান। তাই রাজনীতির সঙ্গে জড়াই। ব্যবসা বিভাগের শিক্ষক হয়েও সে সময় আইনের বিষয়গুলো পড়তাম। কেননা বাবার মামলাগুলো ছিল অদ্ভুত—মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা। হাইকোর্ট, জজকোর্ট, ঢাকা বা কুমিল্লার নিম্ন আদালতে ছুটে বেড়িয়েছি বিচারের আশায়।

এ সময় আওয়ামী লীগের বিরোধী মানেই ‘রাজাকার’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’, কখনো ‘দেশদ্রোহী’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’—তকমা দেওয়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে প্রায়। ভুক্তভোগীরা জানেন, এসব ট্যাগিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব কতটা। পদে পদে হেনস্তা, কী করেনি তারা বিরোধী মত বা যে অনুগত হয়নি, তার ওপর। বাদ গেলাম না আমিও। সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে আমার নিয়োগ তিন বছরের জন্য আটকে দেওয়া হলো। একজন গবেষক বা শিক্ষকের ওপর এই রকম জুলুম ঠিক কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন। বিএনপি ট্যাগিংয়ে যেকোনো গবেষণার প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হওয়া তো তখন নিত্যকার ঘটনা।

২.

এ বছর ৫ জুন যখন কোটা পুনর্বহাল নিয়ে ঘোষণা এল, জানতাম, ছাত্ররা এটা ভালোভাবে নেবে না। কারণ, তত দিনে তাদের বুকের ভেতর অনেক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত।

চোখ রাখছিলাম তাদের আন্দোলনের ওপর। তখনো সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হইনি। কারণ, ২০১৮ সালে তারা ‘অপশক্তির ইন্ধনে বিপন্ন ছাত্রসমাজ’—এই জাতীয় ট্যাগ দিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছিল। তাই ছাত্রদের ওপর সরকারের অত্যাচার আরও বাড়বে, এমন শঙ্কায় ঝুঁকি নিতে পারছিলাম না।
তবে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বললেন, সেটা নিতে পারিনি। বাচ্চা কয়েকটা ছেলের ন্যায্য দাবির বিপরীতে তিনি এমন একটা ‘গালি’ ছুড়তে পারেন! রাতেই দেখলাম, প্রতিবাদে মুখর রাজপথ। থমকে গেলাম তাদের প্রতিবাদের ভাষায়—‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কায়েম করা স্বৈরতন্ত্রের ওপর এই প্রথম সাধারণ মানুষের ভর্ৎসনা।

হল থেকে ছেলেমেয়েরা সব এক এক করে বেরিয়ে আসছে। মেয়েদের হলেও কী অভূতপূর্ব সাড়া! কিন্তু তাদের প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে আমার শঙ্কা।

১৫ জুলাইয়ের হৃদয় নিংড়ানো কিছু ছবি ভাইরাল হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর পত্রিকায়। এই ছেলেমেয়েগুলোর রক্তাক্ত মুখ, আতঙ্কভরা চোখে আমার নিজের মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। আমার মেয়েটা বাইরে পড়ালেখা করছে। সে–ও হলেই থাকে, শিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে।

মন বলল, আর মানা সম্ভব না। এবার দাঁড়াতেই হবে। তাদের ওপর যে বর্বরোচিত হামলা হয়েছে, তার প্রতিবাদে আজ যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই, আগামীকাল তাদের সামনে ক্লাসরুমে দাঁড়াতে পারব না। আর জীবন কিংবা চাকরির ঝুঁকি? যা হয় হবে। ওপরওয়ালা একজন আছেন, শেষ বিচার তিনিই করবেন। এই প্রত্যয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্ক’–এর ব্যানারে আমরা ১০–১২ জন শিক্ষক রাজপথে দাঁড়ালাম। সেদিন থেকে রাজপথে শুরু হলো আমাদের সংগ্রাম। কত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা!

আমার বাসা ক্যাম্পাসের বাইরে। রিকশা, সিএনজি দিয়ে প্রতিবাদস্থলে যেতাম। রাস্তাঘাট থমথমে। পুলিশি বর্বরতা, পিটুনি, ছাত্রলীগের আক্রমণ চলছিলই। বোঝার উপায় নেই ঠিক কখন কোথা থেকে হামলে পড়বে ওরা। পুলিশি ব্যারিকেডে বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এসব উপেক্ষা করেই অপরাজেয় বাংলা, প্রেসক্লাব, ডিবি অফিসে যাওয়া-আসা। 

আমাদের প্রতিবাদের প্রথম দিন শাহবাগ থানায় দুই ছাত্রকে আটকে রেখেছিল। থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে এনেছিলাম। পথে আমাদের সঙ্গে জনগণ যোগ দিল। সেদিন ছিল আশুরা। রোজা রেখেছিলাম। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। কারণ, মাথার ওপর তপ্ত সূর্য। সে সময় আরও বুঝেছি, কী প্রচণ্ড কষ্ট করে ছাত্ররা মাঠে আছে।

১৭ জুলাইয়ের পর থেকেই শুরু হলো নানা রকম বাধা। ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেজে প্রচুর হুমকি পাচ্ছিলাম। আমার চলাফেরার ছবি আমাকে পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হতো। ঘরে ফেরার পর অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন আসে। প্রচুর মেসেজ আসা শুরু হয়। ভিডিও আসতে থাকে। বাসার নিচে লোক ঘোরাফেরা করছিল। ডিবি অফিসের নামে ফোন। রাজপথ ভয়হীন হলেও রাতগুলোও ছিল আতঙ্কের। কারণ, রাতেই তখন কখনো অজ্ঞাতপরিচয়ে বা ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আয়নাঘরের বাস্তবতা বাংলাদেশে তত দিনে বেশ সুপরিচিত। ঘুমাতে পারিনি একটা রাতও। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমাকে তুলে নিতে আসছে।
আমাদের কর্মসূচি একেক দিন একেক জায়গায়। সেভাবে পূর্বপরিকল্পনা করে কোনো কর্মসূচি ছিল না। যেখানেই শুনেছি প্রতিবাদ হচ্ছে, সেখানেই চলে যেতাম। নানা বাধার মুখে পড়েছি। দেখা যেত, সকাল নয়টার দিকে ক্যাম্পাসে আসতে পারব না। কারণ, পুলিশি বাধা কিংবা ছাত্রলীগের তাণ্ডব, তাই ভোরেই চলে আসতাম। কোনো শিক্ষকের বাসায় থাকতাম। প্রতিদিন এভাবে আসা-যাওয়া করেছি।

কত রকমভাবে যে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পেয়েছি এই কয়দিন। যেমন একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাসা থেকে ছাতা আনতে ভুলে গেছি। বৃষ্টির মধ্যে রিকশাওয়ালা মামা আমাকে বলেছেন, ‘তুমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো, মা। আমি একটা এনে দিই।’ দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে তিনি ছাতা কিনে এনে আমাকে দিয়েছেন। আবার আসা–যাওয়ার পথে যখন বলতাম, ‘মামা, আমার ওপর যদি হামলা হয়, আমার বাবার বাসা এখানে, আমাকে একটু ওইখানে পৌঁছে দিয়েন।’ তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই উত্তর ছিল, ‘আমাদের জান যাইব মামা, তোমাগো কিছু হইতে দিমু না।’ মনে আছে, একদিন কী গরম! প্রতিবাদ সমাবেশে দাঁড়িয়ে আছি শাহবাগে। ব্যাগে পানিও শেষ। একজন ভিক্ষুক তাঁর টাকা দিয়ে কোমল পানীয় কিনে খাইয়েছিলেন আমাদের।

যেদিন শুনলাম, ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়েছে এবং তারা অনশন শুরু করেছে, আমাদের ক্ষোভ আর প্রতিবাদ তীব্রতর হলো। আবু সাঈদের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়নি এমন মানুষ নেই, অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, আবু সাঈদ সন্ত্রাসী। এটা মেনে নেয়নি কেউ। মুগ্ধ, ফাইয়াজ, ইয়ামিনের মৃত্যু পুরো জাতিকে দলমত–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে এক করে তুলেছিল।

সরকারি মহলের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ হলো। ক্ষিপ্ত হলো প্রবাসীরা। পরিবারের মানুষ দেশে কেমন আছে, এই আতঙ্ক তো তত দিনে তাদের ভেতরে প্রকট। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় পুরো বিশ্ব থেকে বিছিন্ন হলো বাংলাদেশ। প্রতিবাদী হলো প্রবাসীরাও। সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হলো তাদের রেমিট্যান্স নিয়ে যুদ্ধ।

গোটা বাংলাদেশ এক দিকে, আর সরকার ছিল আরেক দিকে। এর মধ্যে ছাত্র–জনতার গণগ্রেপ্তার তো চলছেই। হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি এবং স্নাইপার শটেও তখন রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। ফ্যাসিস্ট সরকারের হিংস্রতা থেকে রেহাই পায়নি বাবার কোলে থাকা কিংবা বাসার ছাদে খেলতে থাকা ছোট শিশুও।

৫ আগস্ট সকালে আমার বাসার সামনে দেখি একদল মারকুটে চেহারার লোক। তার আগে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। বুকের ভেতর তখন ক্ষোভ এত তীব্র যে কিছুই আর তোয়াক্কার সময় ও ইচ্ছা—কোনোটাই ছিল না। পালিয়ে সেন্ট্রাল রোড দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসছিলাম।

হঠাৎ রাস্তায় দেখি আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ভাই আর নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ আপা। তাঁরাও ছোট মিছিল নিয়ে এগোচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য শাহবাগ। আমাকে তাঁরা নিজদের মাঝখানে রেখে এগোতে লাগলেন। বেশ ভরসা পেয়েছিলাম। বেলা দেড়টার দিকে খবর এল, শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। মুহূর্তে বদলে গেল সব। ১৫ বছর ধরে কষ্ট করছি। বাবাকে জেলে নিল, ছাত্রদের ওপর আক্রমণ হলো। দেড় হাজার ছাত্র-জনতা হত্যার শিকার হলো। আহত ও পঙ্গু ২০ হাজার। শেখ হাসিনার বিদায়ে সেদিন মানুষের মধ্যে কী যে আনন্দ! আমরা শাহবাগে গেলাম। মানুষ আমাদের চিনতে পারছিল। কেউ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে, ফুলের তোড়া দিচ্ছে কেউ। পুরো বাংলাদেশ তখন ফ্যাসিবাদী সরকারের নাগপাশ থেকে মুক্তির আনন্দে উদ্বেল।

* চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক