মনে হচ্ছিল এখনই গুলি লাগবে
কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ। সাউন্ড গ্রেনেডে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা। মুহুর্মুহু গুলিও চলছিল। শিক্ষার্থীরা দিগ্বিদিক হয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। প্রাণ বাঁচাতে কেউ অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। কেউ আশপাশের ভবনের ভেতরে চলে যান। পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট মোড়ে গিয়ে এই দৃশ্যের মুখোমুখি হই। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা নানা দিক থেকে এসে সেদিন মোড়ে মিশেছিলেন। তবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে হামলা চালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও সংঘর্ষ হয়। পরিবেশ কার্যত ভীতিকর হয়ে ওঠে।
সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেদিন সকাল আটটায় আমি নিউমার্কেট মোড়ে পৌঁছাই। তখন মোড়টি সুনসান। গাড়ি চলাচল বন্ধ। দোকানপাটের দরজায়ও তালা ঝুলছিল। পরিস্থিতি বুঝে মোড়ের এক পাশে দাঁড়াই।
সকাল নয়টার পরপর হই হই শব্দ। কিছুটা নিঃশব্দে মোড়ের বাঁ পাশে কোতোয়ালির দিকে এগিয়ে যাই। দেখলাম, একদল শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে নিউমার্কেট মোড়ের দিকে ধাবমান। তাঁদের মাথায় শক্ত করে বাঁধা জাতীয় পতাকা। মুখে স্লোগান, ‘আমার ভাই মরল কেন/ জবাব চাই, জবাব চাই’; ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘আমার খায়, আমার পরে,/ আমার বুকেই গুলি করে’।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তরুণেরা এসে নিউমার্কেট মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। এর পরের দুই ঘণ্টায় মোড়ে আর ঠাঁই নেই দশা হয়েছিল। চারদিক থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মোড়ে এসে জমা হচ্ছিলেন ছাত্র-জনতা। কেউ একা, কেউ সদলবল প্ল্যাকার্ড হাতে এসেছিলেন।
আমরা ধারণা করতে পেরেছিলাম, ৪ আগস্ট নিউমার্কেট মোড়ে বড় ধরনের সংঘর্ষ হবে। ধারণা করার যুক্তিসংগত কারণও ছিল। সেদিন একই জায়গায় গণজমায়েত কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। হলোও তা–ই। বেলা ১১টা পর্যন্ত ছাত্র-জনতার স্লোগান, প্রতিবাদী গান, কবিতাপাঠ চলেছে। আমি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিকের দেখা পেয়ে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। আমাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুজন ঘোষ সিটি কলেজের দিকে অবস্থান নেন। জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ ও জুয়েল শীলও ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
নিউমার্কেট মোড় থেকে কয়েক শ মিটার দূরেই চট্টগ্রাম রেলস্টেশন। কয়েকজন সাংবাদিকসহ আমি স্টেশনের এক পাশে পৌঁছাই। সেখানে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে বিক্ষোভ শুরুর প্রতিবেদন লেখার কাজ করছিলাম সমানতালে। লেখার একফাঁকেই ককটেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দ কানে এসে পৌঁছায়। এরপর স্লোগান থেমে গেল। ছন্দপতন ঘটল।
মোড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, মোড়ের পেছনে অমর চাঁদ সড়কে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটানো হয়। ওই সময় অন্তত পাঁচজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাঁদের মাথায় ছিল হেলমেট। বিরতিহীনভাবে ছাত্র-জনতার দিকে গুলি ছুড়ছিলেন অস্ত্রধারীরা।
মুহূর্তে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে রণক্ষেত্র হয়ে যায় নিউমার্কেট মোড়। একপর্যায়ে পুলিশও ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন দিশাহারা ছাত্ররা। কেউ কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন। ধরাধরি করে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে।
কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল।
এর মধ্যে চোখ আটকে গেল একটি রিকশার দিকে। অমর চাঁদ সড়ক থেকে রিকশাটি আমতলার দিকে এগোচ্ছিল। রিকশায় শোয়ানো নিথর
এক যুবক।
অস্ত্রধারীর কাছাকাছি…
হামলার মুখে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ নিউমার্কেটের পাশে হকার্স মার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকুমুন্ডি লেনের বিভিন্ন বিপণিবিতানের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আরেকটি অংশ স্টেশন সড়ক হয়ে কদমতলী দিকে চলে যায়। একটি অংশ চলে যায় লালদীঘি মোড়ে।
ছাত্র-জনতার যে অংশটি তামাকুমুন্ডি লেনের বিভিন্ন বিপণিবিতানে ঢুকে পড়েছিল, তাদের দিকে তেড়ে যায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। আমি তখন ওই লেনের পাশেই ছিলাম। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার ওপর আবার গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমি ঢুকে পড়ি একটা দোকানে। পরিস্থিতি বুঝে বেরিয়ে নিউমার্কেট মোড়ের এক পাশের পদচারী–সেতুর ওপর গিয়ে দাঁড়াই। সেখান থেকে মোটামুটি সব দেখা যাচ্ছিল। আগেই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ। তিনি জানালেন, দুজন অস্ত্রধারী আশপাশেই আছেন। তাঁরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছিলেন। আমিও নজর রাখলাম।
বেলা পৌনে একটায় দেখলাম, কয়েকজন অস্ত্রধারী একটি বিপণিবিতানের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছেন। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি গুলি এসে গায়ে লাগবে। কয়েকটা গুলি এসে পদচারী–সেতুর হাতলেও লেগেছিল, আমরা কাছেই ছিলাম।
*সুজয় চৌধুরী: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো