স্যালুট দেওয়ার মুহূর্ত

আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের স্যালুট দিয়ে ভাইরাল হন রিকশাচালক মো. সুজন খান। সেটি মনে রেখে সম্প্রতি তিনি একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছেন ক্যামেরার সামনেছবি: সাজিদ হোসেন

রিকশা চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে গেলেই গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ আর মুগ্ধর সঙ্গে ছাত্রদের উদ্দেশে আমার স্যালুট দেওয়া ছবিটিও শিক্ষার্থীরা দেয়ালে এঁকেছে। আমি রিকশাচালক বলে ছাত্ররা আমাকে ভুলে যায়নি। এখন তো আমার নামই হয়ে গেছে স্যালুট সুজন।

আমার বাসায় টেলিভিশন নেই। আমার মুঠোফোনটাও আধুনিক নয়। আমি পুরোনো ধরনের একটা মুঠোফোন ব্যবহার করি। কামরাঙ্গীরচরের বড়গ্রাম এলাকার একটা চায়ের দোকানে আমি কখনো কখনো যাই। সেখানে গেলে দোকানটির মালিক টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল আমার হাতে তুলে দেন। দিয়ে বলেন যা দেখতে মন চায় তাই যেন আমি দেখি। সেখানেই টেলিভিশনের খবরে কোটা আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। আস্তে আস্তে সেই আন্দোলন এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়। সবার সে কী উত্তেজনা, সে কী সাহস! সরকার পতনের সেই আন্দোলনে আমার মন পড়ে ছিল। আমিও এই আন্দোলন সমর্থন করেছিলাম। ছাত্রদের আন্দোলন দেখে আমি যে সময়ে স্যালুট দিয়েছিলাম, স্বৈরাচারী সরকার কিন্তু তখনো গদিতেই ছিল। একপর্যায়ে সরকারের পতন হয়ে গেল।

মো. সুজন খান। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রিকশাচালক

আন্দোলন যখন চলছিল, তখন রিকশা নিয়ে প্রায়ই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। নানা পথ ঘুরে ছাত্রদের পৌঁছে দিতাম গন্তব্যে। ছাত্রদের কত লাশ যে তখন দেখেছি। পুলিশ আর ছাত্রলীগের ছেলেরা ছাত্রী বোনদেরও রেহাই দেয়নি। সবই নিজ চোখে দেখতাম আর ভাবতাম, আমি শুধু শুধুই বসে আছি।

সব দিন–তারিখ তো মনে নেই, কিন্তু কত যে ঘটনা। একদিন ছিল শনিবার। ছাত্ররা এসে স্প্রে দিয়ে পুলিশের গাড়িতে কী সব কথা লিখে দিল। আমি রিকশা নিয়ে দোয়েল চত্বরের কাছে চলে গেলাম। চারদিকে নদীর জোয়ারের মতো ছাত্ররা যাচ্ছে। আমার মনটা কেমন করে উঠল। আমি হঠাৎ রিকশার সিটে উঠে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের স্যালুট দিয়ে দিলাম। আমি আসলে ঠিক ছাত্রদের স্যালুট দিইনি, আমার মনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভেসে উঠেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। তবে এটা জেনেছি, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য নিজের প্রাণের মায়া করেননি। এই আন্দোলনেও ছাত্রছাত্রীরা পুলিশ এবং ছাত্রলীগের ছেলেদের আক্রমণ বা গোলাগুলি নিয়ে ভয় পায়নি। আমার মনে হলো, গুলিকে ভয় না পাওয়া এই ছাত্ররা তো মুক্তির জন্য লড়াই করা যোদ্ধা। শেখ হাসিনার মনে হয়েছিল, তারা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’। আর আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতি। ছাত্রদের স্যালুট দেওয়ার সেটাই ছিল কারণ।

এই আন্দোলনের সময় নিজের কাছে আমি একটা জাতীয় পতাকা রেখেছিলাম। সেই সময়টাতে আমার মাথায় জাতীয় পতাকাটা বাঁধা ছিল। আমি স্যালুট দিয়ে প্রায় ১০ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখি, ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক আর মানুষজন এসে আমার ছবি তুলেছেন। পরে শুনতে পেলাম, আমার সেই ছবিটা নাকি ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল কী জিনিস, সেটা আমি জানতাম না। অনেকেই বলতে থাকল, তুমি তো এখন ভাইরাল। সবাই তোমাকে চেনে। ছাত্ররাও স্যালুট দেওয়া সেই ছবিটা বড় করে প্রিন্ট করে আমাকে দিয়েছে। ঘরের দেয়ালে আমি সেটা লাগিয়ে রেখেছি।

প্রথম আলোতেও আমার সে রকম একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। পাড়ার একজন, সে–ই আমাকে এনে কপিটা দিয়েছে। আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

ছবি ভাইরাল হওয়ার পরও আমি আন্দোলনে যাচ্ছিলাম। অনেকে ভয় দেখিয়েছিলেন, পুলিশ গুলি করতে পারে। আমি মোটেই ভয় পাইনি। রিকশা চালিয়ে কত টাকা ভাড়া পাব, সেই চিন্তাও তখন মাথায় ছিল না। আমার কাছে পানি থাকলে ছাত্রদের দিতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হকাররাও ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

আমার স্যালুট দেওয়ার ছবি দেখে অন্য রিকশাচালকেরাও আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আমাকে চিনতে পেরে এখন অনেকেই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চান। এটা তো অনেক সম্মানের।

আমি দিন আনি দিন খাই। অভাবের সংসার। তবে স্ত্রী শান্তা আক্তার সিনথিয়া আর পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে শুকরান আহমেদকে নিয়ে আমার সুখের সংসার। শান্তা প্রায়ই আমার হাতের তালুতে মেহেদি দিয়ে নিজের নাম লিখে দেয়।

সংসারটা সব সময় এমন সুখের ছিল না। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়েছিলাম। শান্তাকে অনেক অত্যাচার করতাম। সেসব সঙ্গ বাদ দিয়েছি। শান্তা আর আমি এখন বন্ধুর মতো হয়ে গেছি। এখন বুঝতে পারি, পারিবারিক অশান্তি করে ভালো থাকা যায় না।

ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি ছিলাম। অন্যায় দেখে চুপ করে থাকতে পারতাম না। নিউমার্কেটে কুলিগিরি করেছি। রাস্তায় থেকেছি। মানুষের মার খেয়েছি। কত কষ্ট যে করেছি, বলে শেষ করা যাবে না। তবে মানুষের বিপদে কখনো চুপ করে বসে থাকিনি।

অর্থসম্পদ না দিলেও আল্লাহ একটা মন দিয়েছেন। সাভারের রানা প্লাজায় ধস হলো। সাভার যাওয়ার টাকা নেই। একটা ট্রাকের পেছনে বসে গালি খেতে খেতে কামরাঙ্গীরচর থেকে সাভারে গিয়েছিলাম। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অনেককে উদ্ধার করেছি। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পরে খাল থেকে বহু লাশ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছি।

মা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলতেন। মা বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন, তাঁর ছেলেকে এখন অনেকেই সম্মান করে। বড় বড় মানুষদের বলি, আমাদের দাম দিয়েন।

আগের সরকার তো দেশটাকে কিনেই ফেলেছিল। পদে পদে চাঁদা দিতে হতো। দেশটাকে মুক্ত করার জন্য ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের মতো মানুষেরাও তাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।
এখন আমরা আর কাউকে চাঁদাবাজি করতে দিতে চাই না।

যাঁরা রিকশা চালান, তাঁদের মাথাটা অনেক সময় একটু গরম হয়ে থাকে। তাই রিকশাচালকদের সঙ্গে সবাইকে ভালো ব্যবহার করতে অনুরোধ করি। নতুন সরকারকে বলি, তারা যেন অবশ্যই গরিবদের দিকে তাকায়। সরকার চাইলে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাকে একটা চাকরি দিতে পারে। পড়াশোনা না জানলেও যেকোনো পরিশ্রমের কাজ করতে পারব। কাজটা যাতে শুধু সম্মানের হয়, এইটুকুই চাওয়া।

জীবনে কি কখনো কল্পনা করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় আমার ছবি থাকবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এলেই ছবিগুলো চোখে পড়ে। আন্দোলনের পরেও এই ছবিগুলোর জন্য আমি মানুষের মনের মধ্যে জায়গা পেয়েছি।

(অনুলিখিত)

* মো. সুজন খান: আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রিকশাচালক