আমাদের সম্মিলিত সাহস

‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। ২ আগস্ট ২০২৪ছবি: আশরাফুল আলম

খিদে লাগার অনুভূতি যেন চলে গিয়েছিল তখন। খাওয়া বলতে যা বোঝায়, তা অধিকাংশ সময় কেবল রাতেই হতো। দেখা যেত, সকাল ১০টায় না খেয়ে হল থেকে বের হতাম, মিটিং করতাম, মিছিল করতাম আর রাত ১০টায় রুমে ফিরে আগামী দিনের কর্মসূচিতে কীভাবে আরও মেয়েদের আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতাম। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগাযোগ করতাম মেয়েদের সঙ্গে। এর বাইরে ১ জুলাই থেকে কোনো জীবন ছিল না। আসলে জুন মাসের পর জুলাইয়ে যে সময় কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়াতে শুরু করল, সেই থেকে একটি রাতও ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি, শুধু টেনশন হতো—কখন কী হয়। 

 তেমনই একটা দিন ছিল ১৪ জুলাই। এদিন সকাল থেকে অসুস্থ ছিলাম। ‘মার্চ টু বঙ্গভবন’ কর্মসূচি করেছি, রোদে পুড়েছি। সব কাজ শেষে রাত আটটার দিকে বাইরে থেকে ভাত কিনে যখন হলে ঢুকছি, তখন মাথা ঝিমঝিম করছি খিদেয়, কিন্তু ক্রোধের চোটে খেতে পারছি না।

১৪ জুলাই সন্ধ্যায় জানতে পারি, শেখ হাসিনা আমাদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলেছেন। মুহূর্তে রক্ত মাথায় উঠে গেল। তখন থেকেই ভাবছি, কীভাবে এই অপমানের জবাব দেব। সারা দিনের খাটাখাটুনিতে সে সময় আমি খুব ক্লান্তও বটে। তবু হলে পৌঁছার একটু পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, মিছিল করব। আশ্চর্য ব্যাপার, ক্লান্তিভাব কেটে গিয়ে চাঙা হয়ে উঠল মন। কোনোমতে দুই লোকমা ভাত গিলে নিচে গিয়ে দেখি মেয়েরা সব ক্ষোভে ফুঁসছে। মিছিল নিয়ে বের হলাম আমরা। এর পরের দিন বেধড়ক মারল আমাদের। মার খেলাম আমিও।

যুক্ত হলো মেয়েরা

৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আন্দোলন শুরুর পর থেকেই ছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে আন্দোলনের কার্যক্রম চলত। এখানে সে সময় মেয়েদের উপস্থিতি খুবই কম ছিল। তখন আমার মনে হলো মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে আমার হলের জুনিয়র রুকু আক্তার ও সায়মার সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করলাম। তারাও একমত হলো আমার সঙ্গে। পরে আমরা হলের অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বললাম। আমাদের সুফিয়া কামাল হলের জন্য একটি আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জার গ্রুপ খুললাম। কিন্তু আন্দোলনের প্রতি সমর্থন থাকলেও মিছিল বা কার্যক্রমে অংশ নিতে মেয়েরা ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। তখন আমরা মেয়েদের বলতাম, ‘আওয়ামী লীগের শাসনকালে সরকারের কাছ থেকে আমরা একটিমাত্র দাবি আদায় করতে পেরেছিলাম—কোটা বাতিল। এখন সেটি পুনর্বহাল করে সরকার আমাদের অপমান করেছে। এরপরও কি চুপ থাকবেন? নিজেদের অপমান মেনে নেবেন?’ এমন ধরনের কথায় মেয়েদের আঁতে ঘা লাগে। ধীরে ধীরে আন্দোলনে যুক্ত হয় তারা। প্রথমে ২ জুলাই তিনজন মেয়ে নিয়ে এলাম হল থেকে। ৩ জুলাই হলো ১০ জন। আমাদের কর্মসূচি যখন থাকত, প্রায় একই সময়ে কর্মসূচি দিত ছাত্রলীগ। অনেক মেয়ে সেই কর্মসূচি এড়ানোর জন্য আগেভাগে হল থেকে বের হয়ে যেত। এরপর আমাদের কর্মসূচিতে যুক্ত হতো টিএসসি থেকে। ধীরে ধীরে জনসংযোগ বাড়ালাম। আমরা যারা সংগঠক ছিলাম, তারা হলের মেয়েদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে শুরু করলাম। এতে মেয়েরাও ভরসা পেল। ৬ জুলাই মেয়েদের একটা বড় দল নিয়ে এলাম হল থেকে। সেদিন আমাদের কী আনন্দ! শরীর ও মাথায় বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে মিছিল করলে একটা শিহরণ জাগত মনে। মনে হতো, আমরা সফল হবই। মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমে বেড়েই চলল। এ সময় নাহিদ ইসলাম ভাই বললেন, ‘আন্দোলন পরিচালনার জন্য মেয়েদের হল থেকে পাঁচজন প্রতিনিধি লাগবে।’ এবার আমরা কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা পড়লাম বিপদে। আন্দোলনে সবাই থাকবে, কিন্তু কেউ প্রতিনিধি হতে চায় না। চারবার নাম পরিবর্তন করে এরপর প্রতিনিধিদল নির্বাচন করতে পেরেছিলাম।

তীরহারা ঢেউয়ের সাগরে

এর মধ্যে ছাত্রলীগের এক নেতা আমার ভাইকে ফোন করে আমার খোঁজখবর নেওয়ায় ভয় পেয়ে গেলেন বাড়ির লোকজন। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা–মায়েরা যা করেন, তাঁরাও আমার সঙ্গে তা-ই করলেন, থামাতে চাইলেন আমাকে। কিন্তু আমি পিছু হটিনি। খাওয়া, ঘুম—কোনো কিছুর ঠিক নেই। বাংলা ব্লকেড দিয়ে স্লোগান দিচ্ছি। গাইছি, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’, ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’। 

মনে আছে, ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার দিন তীব্র রোদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আসলে তখন ঠিকমতো খাওয়ার সময়ও পেতাম না। বমি করতাম প্রায় প্রতিদিন সকালে।

তত দিনে আমার পেছনে টিকটিকি লেগেছে। পুলিশের লোকজন অনুসরণ করত আমাদের। তবে ভয় পাইনি। কারণ, প্রতিদিনই মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছিল। একসময় সুফিয়া কামাল হল থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা চাঁদা তুলে আন্দোলনের জন্য একটা মাইক কিনলাম আর স্থায়ী ব্যানার বানালাম। আমাদের সাহস ও উৎসাহ তখন তুঙ্গে।

আমরা কি হেরে গেলাম?

উমামা ফাতেমা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র; সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক

দমে গেলাম ১৬ জুলাই। ওই দিন প্রশাসন ক্যাম্পাস ও হল বন্ধের ঘোষণা দিল। আমি বললাম, আমরা কেউ যাব না। অনেক মেয়েই রাজি হলো। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই দেখি, তৎকালীন হল প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে একে একে চলে যাচ্ছে মেয়েরা। এমনকি আমার রুমমেটও দেখলাম পাগলের মতো ব্যাগ গোছাচ্ছে। সে সময় কেমন যে অসহায় লাগছিল! বারবার মনে হচ্ছিল, আমরা কি হেরে গেলাম?

ওই দিন রাত আটটার দিকে ভাই এসে আমাকে নিয়ে গেল চাচার বাসায়। ঢাকায় থাকলেও ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়লাম। ইন্টারনেটও বন্ধ। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার আগে অবশ্য ফেসবুকে আমি একটা ভিডিও বার্তা দিয়ে বলেছিলাম, আমরা আলোচনায় বসব না। বাড়ির লোকজনের চাপে পড়ে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হই।

কিন্তু ঘরে বসে থেকে আমি কী করি! ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’—এসব স্লোগান, আন্দোলন ছাড়া কিছু চিন্তাও করতে পারতাম না। একসময় মনে হলো, যা হওয়ার হবে, যাদের নম্বর আছে, প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ করব। এই ভাবনা থেকে আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকি। সে সময়গুলোতে নিরাপত্তার খাতিরে আমাদের অনেকের মুঠোফোন বন্ধ ছিল। তবে আমি চালু রেখেছিলাম।

এবং ৬২ জন সমন্বয়কের বিবৃতি

১৯ জুলাই বিকেলে আমাকে ফোন করলেন আন্দোলনের সহযাত্রী ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। বললেন, ‘তুমি একটা বিবৃতি লেখো।’ এটিই ছিল ‘আন্দোলন চলবে’ শিরোনামে ৬২ জন সমন্বয়কের বিবৃতি, যা ২১ জুলাই পত্রিকায় ছাপা হয়। বিবৃতিটির উদ্দেশ্য ছিল টিভিতে দেখানো ৮ দফাকে খণ্ডন করা। আবদুল কাদের যে ৯ দফা দেবে, তখনো আমি তা জানতাম না। 

ইন্টারনেট বন্ধের সময় পত্রিকায় দুটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়—৬২ জন সমন্বয়কের বিবৃতি আর আবদুল কাদেরের ৯ দফা। প্রথম বিবৃতিটি যৌথ নামে ছাপা হলেও এটি লিখেছিলাম আমি আর আমার ভাই। আসাদ ভাই বিবৃতিতে কী লেখা যেতে পারে, তা আমাকে বললেন। সে অনুযায়ী ভাইয়ের মুঠোফোনের খুদে বার্তায় ধাপে ধাপে লিখে আসাদ ভাইকে পাঠাচ্ছিলাম আমি এবং তিনি ভাষা ঠিক করে দিচ্ছিলেন। এ সময় ফোন করে সাহস দিয়েছিলেন নাহিদা সরওয়ার নিভা আপু। আর ৬২ জন সমন্বয়কের তালিকা পাঠিয়েছিলেন আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন।

বিবৃতিটি নিয়ে আসাদ ভাই, নিভা আপু, আমি ও আমার ভাই সেদিন যুদ্ধই করেছিলাম। মনে হচ্ছিল, কোথাও এটি ছাপা হবে না, কেউ জানতেও পারবে না, কী আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম আমরা। অসহায়ের মতো ডাইনিং টেবিলে বসে বিভিন্নজনের কাছে খুদে বার্তা মারফত পাঠাচ্ছিলাম বিবৃতি। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষের কাছে যেন আমাদের বার্তা পৌঁছায়।

এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কত বুক খালি হলো, আপন হলো কতজন। সবার কত সাহস দেখলাম। সম্মিলিত সাহসের ফল আমাদের এই গণ–অভ্যুত্থান।

* উমামা ফাতেমা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র; সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক