পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে
গত দুই যুগে প্রথম আলো তার যাত্রাপথে অগণিত বন্ধু ও সুহৃদ পেয়েছে। তাঁদের অনেকে এখনো প্রথম আলোর সঙ্গে আছেন। আবার অনেককে আমরা হারিয়েছি।
চলতি বছরই কয়েকজন সুহৃদ চলে গেছেন; যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো; তাঁদের জ্ঞান, মেধা ও লেখনী প্রথম আলোকে ঋদ্ধ করেছে, আলোকিত করেছে সমাজ ও মানুষকে।
প্রথম আলো যাঁদের চিন্তা ও স্বপ্নকে ধারণ করে দুই যুগ আগে যাত্রা শুরু করেছিল, তাঁদের একজন ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি একাধিকবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়; তিনি গণতন্ত্র উত্তরণে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েই তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্রসংক্রান্ত ধারাগুলো বাতিল করেছেন। এ কারণে কেবল প্রথম আলো নয়, গোটা গণমাধ্যম তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোর সূচনাসংখ্যায় দেওয়া বাণীতে বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে সংবাদপত্রকে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য দিতে হবে।’ প্রথম আলো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এ নীতিই মেনে চলেছে।
প্রথম আলোর আরেক সুহৃদ আকবর আলি খান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এসব ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয় ছিল, তিনি একজন মননশীল লেখক ও চিন্তক। দেশ, সমাজ, অর্থনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো প্রথম আলো পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে সব সময় সচেষ্ট ছিল। প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন থেকে তাঁর প্রকাশিত বইগুলো পাঠকমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। গত বইমেলায় তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড পুরানো সেই দিনের কথা প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ শেষ করার আগেই তিনি চলে গেলেন।
প্রথম আলোর জন্মলগ্ন থেকেই আবুল মাল আবদুল মুহিত যুক্ত ছিলেন। প্রথম দিকে নিয়মিত লিখতেন। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বহুবার প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্তব্য লিখেছেন। এমনকি প্রথম আলোয় প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে সরকারি মহলে ‘ঝড়’ উঠলেও প্রথম আলো তাঁর শুভেচ্ছা ও সহৃদয়তা থেকে বঞ্চিত হয়নি। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সরকার প্রথম আলোর ওপর এত ক্ষুব্ধ কেন? তিনি অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বলেছিলেন, সরকার ক্ষুব্ধ নয়...। তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারও প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল মৃত্যুর কয়েক দিন আগে।
প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের সঙ্গেও প্রথম আলোর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হার্দিক। নানা উপলক্ষে তাঁর লেখা ও সাক্ষাৎকার প্রথম আলোকে ঋদ্ধ করেছে। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস আগুনপাখি বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়। পরে এটি প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই হিসেবে পুরস্কার পায়। প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের জুরিবোর্ডের প্রধান/সদস্য হিসেবেও তিনি একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন।
কবি, কথাশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার আলোচনায় আসেন বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে। সিইসিসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার যখন ভেজাল ভোটকে সহিহ্ বলে চালিয়ে দিতে চাইলেন, তখন তিনি সাহস করে প্রকৃত সত্যটি দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রথম আলোয় দেওয়া সাক্ষাৎকারেও মাহবুব তালুকদার নির্বাচন নিয়ে তাঁর মনোবেদনা প্রকাশের পাশাপাশি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে শিগগিরই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ গ্রন্থ নির্বাচননামা।
প্রথম আলোর সূচনাসংখ্যা থেকে অনেক বছর নিয়মিত লিখেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এই বরেণ্য লেখক-সাংবাদিক উত্তর প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন একুশের অমর গানের রচয়িতা হিসেবে। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের জুরিবোর্ডের প্রধান/সদস্য হিসেবে গীতিকার গাজী মজাহারুল আনোয়ারও সব সময় প্রথম আলোর সঙ্গে ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে’। সখা মানে সুহৃদ, বন্ধু, আপনজন। আরও অনেকের সঙ্গে তাঁরাও ছিলেন প্রথম আলোর পান্থজনের সখা।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
সোহরাব হাসান, যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো