রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা
তারেক মাসুদ: একটি জাদুকরি ওভারকোট
জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
বুসানের ক্লোজিং পার্টিতে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটা দেশের ফিল্মেমেকারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন ডমিনিক ওয়েলেনস্কি নামের একজন ফরাসি প্রযোজক। এই ভদ্রমহিলার তারেক মাসুদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে! সেখানে তারেক মাসুদ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে যে কথাটা আমি বলেছিলাম, সেটা দিয়েই শুরু করি! রুশ লেখকদের ওপর নিকোলাই গোগলের ছোটগল্প ‘ওভারকোট’–এর প্রভাব বোঝাতে গিয়ে বলা হয়, গোগল–পরবর্তী লেখকেরা বের হয়ে এসেছেন তাঁর ওভারকোট থেকে। সেখান থেকে কথাটা ধার করে বলেছিলাম, আমরা বেরিয়ে এসেছি তারেক মাসুদের ওভারকোট থেকে।
এখন এই কথাটা যে বললাম, সেটা কি শিল্পের ঝোঁক এবং সময়ের চিহ্ন বিচারে ঠিক হলো? তারেক মাসুদের কাজ সেই অর্থে র্যাডিক্যালি নতুন কোনো ভাষাভঙ্গি তৈরি করে না। তিনি নিজেও কখনো এটা দাবি করেননি। তবে নিজেকে তিনি নিয়মিত নবায়নের দিকে নিয়ে গেছেন। আমার মনে আছে, নরসুন্দর বানানোর সময় বেশ কিছুদিন তারেক ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আমি তখন নাকে-মুখে কাজ করি, তিরিশ দিনই। হঠাৎ একদিন তারেক ভাইয়ের দরাজ গলার ফোন, ‘কী করো? বাসায় আসো। একটা জিনিস দেখাব তোমারে!’ তারেক ভাইয়ের শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস আমাকে কৌতূহলী করে। পরদিন তাঁর বাসায় ঢোকামাত্রই, ‘মিয়া, আমি তো শিং ভাইঙ্গা বাছুর হইতেছি!’ আমি হেসে জানতে চাইলাম ব্যাপার কী?
ব্যাপার আসলে নরসুন্দর! তারেক ভাই আমাকে প্রায়ই একটা কথা বলতেন, ‘মিয়া, তুমি শুট করছ তিন হাজার ঘণ্টা, আর আমি করছি তিন শ ঘণ্টা! ফলে তোমাদের মতো না হইলেও আমি চেষ্টা করতেছি শিং ভাইঙ্গা বাছুর হওয়া যায় কি না।’ যাঁরা নরসুন্দর দেখেছেন, তাঁরা এই কথার সারমর্ম পুরোটাই বুঝতে পারবেন। অভিনয়শিল্পী হ্যান্ডল করা, নতুন ঢঙে গল্প বলা, এমনকি বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নরসুন্দর–এ এসে আক্ষরিক অর্থেই উনি শিং ভেঙে বাছুর হয়েছেন। তারেক মাসুদ জাতীয়তাবাদের যে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের মধ্যে বড় হয়েছেন, সেখান থেকে এসে নরসুন্দর করা সহজ কাজ ছিল না। আজকের বিষাক্ত পরিবেশে এই ছবি বানালে তাকে রাজাকার অ্যাপোলজিস্ট বানিয়ে দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকত।
তো শুরুতে যে বললাম, আমরা তাঁর কোটের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছি, সেটা কীভাবে? তারেক মাসুদ কালচারাল হেজিমনির ভেতর থেকে উঠে এলেও ওনার চোখটা ছিল ভবিষ্যতে। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখা লোক ছিলেন এই তারেক মাসুদ। শুধু স্বপ্ন দেখতেনই না, সেটা বাস্তবায়ন করার জেদ, এলেম এবং অধ্যবসায় তিনটাই ছিল তাঁর। যে কারণে কানে বাংলাদেশের প্রথম ছবি হিসেবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে তাঁর নির্বাচিত হওয়াটা আমি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখি। তারেক মাসুদের আগে আমাদের সব স্বপ্নের দৌড় ছিল কলকাতা পর্যন্ত। তিনি এসে আমাদের বিশ্বাস করালেন, পৃথিবীটা আরও বড়। তিনি আমাদের আত্মবিশ্বাসী করলেন, ঈর্ষাকাতর করলেন, স্বপ্নবান করলেন।
জেদ, এলেম আর অধ্যবসায়—এই তিনটা গুণ কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়েছি বলে মনে করি। আমাদের কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে বড় জ্বালানিও কিন্তু এই তিন গুণই!
তারেক মাসুদের কথা বলতে গেলে তাঁর আরেকটা গুণের কথা বলতেই হবে। সেটা হচ্ছে তাঁর একটা ঝোঁক ছিল অল্প বয়সীদের সঙ্গে সময় কাটানো। আমি তো তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিই। এমনকি আমার চেয়ে অনেক কম বয়সী যাঁরা, আমার ১৪ নম্বর সহকারী পরিচালকও তারেক মাসুদের কাছে একই ট্রিটমেন্ট পেত, একই আশকারা পেত, একই মনোযোগ পেত। এটা আমাদের কালচারাল প্র্যাকটিসের উল্টো ধারাই বলতে হবে। ফলে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর পরবর্তী ফিল্মমেকারদের উনি নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন।
আগেই বলেছি, তারেক মাসুদের চোখ ছিল ভবিষ্যতের দিকে। যখন বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনে তাঁর সহযোদ্ধারা ৩৫ মিমি বনাম ডিজিটালের লড়াইয়ে জীবনপাত করছেন, তখন তিনি ডিজিটাল মিডিয়ামে ফিল্ম এডিট শুরু করে দিয়েছেন, ডিজিটালি ছবি শুট করছেন। আজকের দিনে বসে হয়তো এটার ইমপ্যাক্ট বোঝা মুশকিল হবে। কিন্তু সেই সময়ে এটা ছিল চলচ্চিত্র আন্দোলনের ‘পবিত্রতা’র সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা! তারেক মাসুদ জানতেন যেটা সেদিনের বিচারে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’, সেই একই জিনিস ভবিষ্যতের বিচারে হয়ে উঠবে নতুন দিনের দিশা। সেদিন তাঁর সেই সব সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে তার পরের ফিল্মমেকারদের উদ্বুদ্ধ করেছে নতুনের আলিঙ্গনে। ‘নতুনের আলিঙ্গন’ কথাটা বলতে যতটা আরাম লাগে, চর্চা করা ততোধিক কঠিন। তারেক মাসুদ সেটা করেছেন কেবল প্রযুক্তির দিক থেকেই নয়, বিষয়ের দিক থেকেও, দর্শনের দিক থেকেও। তার উপকারভোগী আমরা, তাঁর পরের ফিল্মমেকাররা। ফলে তারেক মাসুদের আস্তিন আমরা কী করে অস্বীকার করব?
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: চলচ্চিত্রকার