ইন্টারনেট সরকারই বন্ধ করেছিল, লিখেছি আমরা
সেদিন ছিল ১০ তারিখ; অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১০ জুলাই। কারওয়ান বাজার থেকে সেগুনবাগিচায় একটি কাজে যেতে হবে। চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। রাস্তায় নামতেই বোঝা গেল, পুরো শহরটাই স্থবির হয়ে আছে; অর্থাৎ ‘বাংলা ব্লকেড’ সফল।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে টানা কর্মসূচি শুরু হয়েছিল ৫ জুন থেকে। আন্দোলনে পরিচিত মুখের নেতা ছিল না, দেওয়া হচ্ছিল অভিনব সব নামের কর্মসূচি, একডাকে সব শিক্ষার্থী নেমে আসতেন সড়কে—সব মিলিয়ে এই আন্দোলন ছিল ভিন্ন ধরনের। আন্দোলন চলছিল, সেই সঙ্গে বাড়ছিল হালনাগাদ সংবাদের চাহিদা; অর্থাৎ অনলাইনে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ সংবাদ দিতে হবে। বাধা এল এ কাজে। ১৪ জুলাই মধ্যরাত, খবর এল, কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে। এলাকাটি তখন বিক্ষোভে উত্তাল। রাত দেড়টার দিকে জানা গেল, মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। আন্দোলন দমাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে শক্তি প্রয়োগ শুরু করে। শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত ছবি ও ভিডিও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই দুপুরের দিকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার। রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও দেখা দেয় ধীরগতি। ওই দিনই রংপুরে নিহত হন আবু সাঈদ।
বোঝা যাচ্ছিল যে ইন্টারনেটের ওপর আরও খড়্গ নামবে। ঠিক সেটাই হলো। ১৭ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা পায় মোবাইল অপারেটররা। তারপরও ১৮ জুলাই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। তখনো রাত ৯টা বাজেনি। হোয়াটসঅ্যাপে এক বন্ধুকে বার্তা পাঠালে তা যাচ্ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে দেশের মানুষ এবার পুরোপুরি ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের শিকার। সংযোগদাতারাও জানান, সরকার ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে।
অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। সবার প্রশ্ন, ইন্টারনেট কবে ফিরবে? সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলককে ফোন দিলে জানালেন, ‘মহাখালীতে দুর্বৃত্তদের আগুনে ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে। কবে নাগাদ ইন্টারনেট–সেবা চালু হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’
যদিও সংবাদকর্মী হিসেবে জানি যে ডেটা সেন্টারের কোনো ক্ষতিই হয়নি; বরং পাশের দুর্যোগ ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৮ জুলাই প্রথম আলো অনলাইনে ‘সরকারই ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে আমরা জানিয়ে দিই, সরকার আসলে মিথ্যা বলছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে আসে যে নির্দেশ দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে যে কয়েকটি কথা জনপ্রিয় হয়, তার মধ্যে একটি ছিল ‘নাটক কম করো পিও’। এমনই এক ‘নাটক’ দেখতে ২৩ জুলাই মহাখালীতে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, প্রতিমন্ত্রী ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ ডেটা সেন্টার দেখতে যাবেন। বড় এক বহর নিয়ে পলক মহাখালী যান। ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলতে থাকেন তিনি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়েন।
টানা পাঁচ দিন দেশকে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রেখে ২৩ জুলাই ধীরে ধীরে তা সচল করে বিগত সরকার। যদিও সে ইন্টারনেট ছিল কচ্ছপগতির। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন বার্তা আদান-প্রদানের প্ল্যাটফর্ম বন্ধ রাখা হয়। অন্যদের ওপর বিধিনিষেধ দিয়েও প্রতিমন্ত্রী পলক কিন্তু নিজে ফেসবুকে সক্রিয় থেকে ঠিকই নিয়মিত পোস্ট দিচ্ছিলেন। টানা ১০ দিন পর চালু হয় মোবাইল ইন্টারনেট। আর ১৪ দিন পর আবার চালু করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
এবার শেষ দিনের কথা। ৫ আগস্টে বেলা ১১টার দিকে সংবাদ পাওয়া গেল যে এবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; অর্থাৎ পাঠকদের হালনাগাদ তথ্য দেওয়া আবারও বন্ধ। কিন্তু একটু পরই বদলে গেল পরিস্থিতি, ‘ব্রেকিং নিউজ’। দুপুরে সেনাপ্রধান বক্তব্য দেবেন। বেলা দেড়টার দিকে চালু হয়ে গেল ইন্টারনেট। কিছু পরে চারদিক থেকে তখন শোনা গেল মানুষের উল্লাসধ্বনি। জানা গেল, বিশেষ এক বিমানে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা।
*সুহাদা আফরিন: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো