সবাইকে একত্র করতে পেরেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের এক দফা—মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনটির সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন প্রথম আলোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এ ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করার সুযোগ হয়েছিল আমার।
শুরুতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ নামে আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরে তা পরিচালিত হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর ব্যানারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। সক্রিয়ভাবেযুক্ত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা। ডান ও বামের কোনো ভেদাভেদ ছিল না, গণ–অভ্যুত্থানে সবাই ছিলেন এক দাবিতে, সেটা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।
আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫ জুন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন হাইকোর্ট ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের একটি অংশ (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) অবৈধ ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়। ২০১৮ সালের আগে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। শিক্ষার্থীরা তখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেদের বশে পুরো কোটাই বাতিল করে দেন।
এবার শিক্ষার্থীরা যখন শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছিলেন, তখন শেখ হাসিনা একটি বক্তব্য দেন। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? (চাকরিতে কোটা) মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরাও পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে, সেটা আমার প্রশ্ন।’ তাঁর এই মন্তব্যের পর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসেন ছাত্রছাত্রীরা। তাঁরা দাঁড়িয়ে যান শেখ হাসিনার মুখোমুখি অবস্থানে, যেটা এর আগের ১৫ বছরে হয়নি।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সেদিন রাতের মিছিলে ক্ষোভ থেকে প্রথমে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়। পরে স্লোগানে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়, বলা হয়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। ওই দিন মধ্যরাতে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী। শিক্ষার্থীরা চলে যাওয়ার পর রাত তিনটায় ক্যাম্পাসে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ।
শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে মানুষের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল আগেই। ক্ষোভের সেই বারুদে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা (১৫ জুলাই) এবং পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শহীদ হওয়া (১৬ জুলাই)। আবু সাঈদকে গুলি করার ভিডিও চিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।
আওয়ামী লীগ সরকার মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল গুলি করে। কিন্তু মানুষ বুক পেতে দিয়েছেন। স্লোগান উঠেছিল, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিয়নশিল্পী, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সাংবাদিক—সব শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার আর টিকতে পারেনি।
সেনাবাহিনীও ছাত্র–জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
শুরুতে সরকার পতনের লক্ষ্য ছিল না
এই আন্দোলনের শুরুটা সরকার পতনের লক্ষ্য নিয়ে হয়নি। শিক্ষার্থীরা সরাসরি সরকারবিরোধী স্লোগানও দেননি। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি তাঁদের আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে, তাঁরা কী করবেন, কীভাবে দাবি আদায় করবেন, তা জানতে চেয়েছিলাম। যদিও সে কৌশল তখনো ঠিক হয়নি। তবে দাবির ব্যাপারে একটা অনড় অবস্থান ছিল।
আন্দোলনের শুরুর দিকে ছাত্রলীগ সংগঠিতভাবে বাধা দেয়নি। শুধু আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে তারা মধুর ক্যানটিনে অবস্থান নিত। তবে হল পর্যায়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী আন্দোলনকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, হুমকি দিয়েছেন।
১৩ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা ‘ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পরদিন শেখ হাসিনার ‘অপমানজনক’ মন্তব্য পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বললেন, ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’, তখন থেকে ছাত্রলীগের নেতাদের বক্তব্যও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সেদিনই ছাত্রলীগ আন্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের হাজির করে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাই রাতে রোকেয়া হল থেকে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিতাড়িত করেন।
এ ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ জুলাই দুপুরের মধ্যে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের নিয়ন্ত্রণ নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
যদিও অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশি অভিযান চালিয়ে ১৭ জুলাই সন্ধ্যার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও হল ছেড়ে যাওয়ার সময় নীলক্ষেত ও শাহবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীদের মারধর করেছিল ছাত্রলীগ। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মনে ছাত্রলীগের প্রতি ক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর ঢাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সরকারি চাকরি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তেমন আগ্রহ থাকে না। কিন্তু তাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে। গড়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ববোধ।
আন্দোলন সংগঠিত যেভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত হওয়ার জন্য হল ও বিভাগভিত্তিক নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও হলগুলোর পাঠকক্ষে গিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্ত হতে আহ্বান জানানো, গণসংযোগ, প্রচারপত্র বিলি ইত্যাদি করা হয়। যেহেতু চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তাগিদও ছিল, ফলে আন্দোলনে আসার আহ্বানে ব্যাপক সাড়া পড়ে। অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে আসেন, অনেকে আসেন প্রচারের ফলে।
প্রচারণার সবচেয়ে বড় উপায় ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’সহ বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, টেলিগ্রাম গ্রুপ প্রভৃতি মাধ্যম ব্যবহার করে আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করা হয়। ফলে দিন দিন আন্দোলনের পরিসর বাড়তে থাকে।
আন্দোলনের প্রথম দিকে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কম ছিল। ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে প্রচার বাড়ানো হয়। ছাত্রীদের মিছিলে আসতে সম্ভাব্য যেসব বাধা ছিল, সেগুলোর ব্যাপারে তাঁদের সাহস দিয়ে আশ্বস্ত করেন আন্দোলনের নেতারা। হল ও ব্যাচভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপগুলোতে কর্মসূচির সময়, অর্থাৎ কখন, কোথায় জড়ো হতে হবে, তা বলা হয়। এই কৌশল কাজে দেয়। একপর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ছাত্রলীগকে এড়াতে ছাত্রীরা আগেই হল থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিতেন। সেখান থেকে কর্মসূচিতে যেতেন।
আন্দোলনের প্রধান নেতারা আন্দোলনের গতিমুখ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু দূর চিন্তা করেছিলেন। এর প্রমাণ মেলে নেতৃত্বের স্তরভিত্তিক পরিকল্পনায়। প্রথম স্তরের নেতারা গ্রেপ্তার বা গুম হলে দ্বিতীয় স্তর, দ্বিতীয় স্তর উপস্থিত না থাকলে তৃতীয় স্তর নেতৃত্ব দেবে—এমন পরিকল্পনা তাঁদের ছিল।
যেমন ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও সামনের সারির অন্য সমন্বয়কেরা নিখোঁজ থাকার সময় সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও হাসিব আল ইসলাম তৎকালীন সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে গভীর রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দেখা করে আট দফা দাবি জানিয়ে এসেছিলেন (১৯ জুলাই রাতে)। দাবির মধ্যে হত্যাকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা, বিচার, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা ইত্যাদি ছিল। যদিও আবদুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক ৯ দফা দাবি আগেই তুলে ধরেন। সেই ৯ দফার মধ্যে ছিল শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
২৬ জুলাই বিকেলে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এবং আসিফের সঙ্গে থাকা আবু বাকের মজুমদারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে জোর করে তুলে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। পরে আরও তিন সমন্বয়ককে (হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও নুসরাত তাবাসসুম) তুলে নেয় ডিবি। হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ককে দিয়ে ২৮ জুলাই রাতে এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানো হয়। এ ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দ্বিতীয় স্তরের নেতৃত্বের (আবদুল হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার ও রিফাত রশীদ) পক্ষ থেকে বলা হয়, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আন্দোলন চলবে। এর ফলে আন্দোলন নতুন করে গতি পায়।
আন্দোলনের নেপথ্যে যাঁরা
আন্দোলনে সচেতনভাবেই কাউকে একক নেতা বা মুখপাত্র করেনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যাঁরা পরিচিত মুখ বা যাঁদের নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে, তাঁদের সচেতনভাবে সামনে আসতে দেওয়া হয়নি। আন্দোলনটি শুরুতে গড়ে তোলেন মূলত ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামের একটি সংগঠনের নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক এই সংগঠন আত্মপ্রকাশ ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গে একসময় ছাত্ররাজনীতি করা কয়েকজন শিক্ষার্থী নতুন সংগঠনটি গড়ে তোলেন। এর আহ্বায়ক হন গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আখতার হোসেন। সদস্যসচিব হন নাহিদ ইসলাম, যিনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হন এখনকার অন্তর্বর্তী সরকারের আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আলোচনায় আসা আখতার হোসেন পরের বছর ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আখতার হোসেনের পাশাপাশি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও শিক্ষার্থীদের অধিকারের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় থেকে আগে থেকেই পরিচিত মুখ ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এখনকার আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ রেজিস্ট্রার ভবনে অনিয়ম ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি নিয়ে আন্দোলন করে আলোচনায় এসেছিলেন। সাবেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের প্রতিনিধি হিসেবে আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি অমর একুশে হল সংসদের নির্বাচিত সদস্য (ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে) ও বিতার্কিক হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে ২০২০ সালের শুরুতে ৫৫ দিন রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করে পরিচিতি পান। তখন তিনি ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা।
আন্দোলনে শুরু থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দুই শিক্ষার্থী মাহফুজ আলম ও আখতার হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই রাজনৈতিক সাহিত্য পড়াশোনা, আড্ডাসহ বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত থাকা মাহফুজ ছিলেন কার্যত ছাত্রশক্তির ‘মস্তিষ্ক’। তিনি এখন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে একে একে যুক্ত হয় ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্রপক্ষসহ বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি ছিল না। কিন্তু শিবিরের নেতা–কর্মীরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
আন্দোলনের শুরুতে ৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬৫ সদস্যের যে সমন্বয়ক দল গঠন করা হয়েছিল, ৩ আগস্ট তা বর্ধিত করে ১৫৮ সদস্যের করা হয়। অবশ্য মূল নিয়ন্ত্রণ ছাত্রশক্তির নেতাদের হাতেই ছিল। সংগঠনটি অনেকটা সচেতনভাবেই এই নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ছাত্রশক্তির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল, তখন তাতে যোগ দিতেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত সাত কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতেন।
সবার উদ্বেগের বিষয় ছিল, সরকারি চাকরিতে কোটা ফিরলে মেধাবীদের সুযোগ সংকুচিত হবে। দেশে চাকরির সংকট ও উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে উচ্চহারে বেকারত্ব শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন করেছিল।
যোগ দেন শিক্ষকেরা
প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আগে থেকেই সক্রিয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদে নেমে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষকেরা। তাঁরা শুধু বক্তব্য–বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, কর্মসূচিও পালন করছিলেন। তাঁদের ব্যানার ছিল ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক’।
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে’র ডাক দেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষকেরা। সেই সমাবেশে অনেক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সাদা দলের শিক্ষকেরাও তাতে যোগ দেন। সমাবেশ থেকে শাহবাগ থানায় গিয়ে শিক্ষকেরা দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনেন।
২৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ১২ জন শিক্ষক হাজির হন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ের সামনে। তাঁরা ডিবির হেফাজতে থাকা শিক্ষার্থীদের পরিবারের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান।
ব্যক্তিগতভাবে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন।
পর্যবেক্ষণ
৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ শেখ হাসিনাকে দ্রুততম সময়ে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু শেখ হাসিনা শুরু থেকেই এ ব্যাপারে অনমনীয় ছিলেন। শিক্ষার্থী আন্দোলনকে, এমনকি শিক্ষার্থীদেরই পাত্তা দিতে চাননি তিনি। উল্টো দমন-পীড়নের পথে হাঁটে তাঁর সরকার। অপমান আর নির্যাতনই একটা নিরীহ দাবিতে চলমান আন্দোলনের স্বরূপ পাল্টে দেয়।
প্রাথমিকভাবে ছাত্রশক্তির নেতাদের লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের সংগঠনের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কিছু ‘ফেস’ (মুখ) তৈরি করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অনমনীয় ও দমনমূলক ভূমিকা এই আন্দোলনকে সরকার পতনের এক দফায় নিয়ে যায়। সরকারের চূড়ান্ত পর্যায়ের দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ লাখ লাখ মানুষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে মাঠে নামেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।
অভ্যুত্থানের পরে
সমন্বয়ক দল (টিম) বিলুপ্ত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে ২২ অক্টোবর। এর আহ্বায়ক করা হয়েছে হাসনাত আবদুল্লাহকে। অন্যদিকে আন্দোলনে থাকা তরুণেরা গঠন করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি। ৬২ সদস্যের এই কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। নাগরিক কমিটি বলছে, তাঁদের স্বপ্ন, বাংলাদেশকে একটি ‘শক্তিশালী রাজনৈতিক দল’ উপহার দেওয়া।
* আসিফ হাওলাদার: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো